বিশ শতকের ভারতে কৃষক: WBBSE ক্লাস 10 ইতিহাস (History)

বিশ শতকের ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থীআন্দোলন বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা
Share with others

এখানে (chapter 6) বিশ শতকের ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থীআন্দোলন: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা, WBBSE ক্লাস 10 ইতিহাস (History) (Bengali medium) আধুনিক ভারতের ইতিহাস ও পরিবেশ (Adhunik Bharater Itihas O Poribesh)-এর উত্তর, ব্যাখ্যা, সমাধান, নোট, অতিরিক্ত তথ্য, এমসিকিউ এবং পিডিএফ পাওয়া যাবে। নোটগুলো শুধুমাত্র রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করুন এবং প্রয়োজনমতো পরিবর্তন করতে ভুলবেন না।

Select medium
English medium notes
Bengali medium notes

Register Login

সারাংশ (summary)

বিশ শতকের ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলন : বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা (Bish Shotoker Bharote Krishok, Shromik o Bamponthi Andolon: Boishishto o Porjalochona) এই অধ্যায়ে আমরা জানবো, বিশ শতকে ভারতের কৃষক আর শ্রমিকরা কীভাবে নিজেদের অধিকারের জন্য লড়েছিল এবং কীভাবে বামপন্থী দলগুলো এই লড়াইয়ে যোগ দিয়েছিল।

উনিশ শতকের মতোই বিশ শতকেও কৃষকরা জমিদারের শোষণ আর ব্রিটিশ সরকারের অন্যায়ের বিরুদ্ধে অনেকবার রুখে দাঁড়িয়েছিল। তবে এই সময়ের আন্দোলনগুলোর একটা নতুন দিক ছিল – এগুলো ধীরে ধীরে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে জুড়ে গিয়েছিল। প্রথমে বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলন, পরে অসহযোগ, আইন অমান্য, ভারত ছাড়ো – এই সব বড় আন্দোলনে কৃষকরা দলে দলে যোগ দেয়। জাতীয় কংগ্রেস কৃষকদের জন্য আলাদা করে খুব বেশি কিছু না করলেও, তাদের নেতারা ডাক দিলে কৃষকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলনে সামিল হতো। কৃষকদের দাবিদাওয়ার সাথে দেশের স্বাধীনতার দাবিও জুড়ে গিয়েছিল। পরে কংগ্রেসের ভেতরেই সমাজতন্ত্রী দল তৈরি হলে এবং বামপন্থী দলগুলো শক্তিশালী হলে কৃষক আন্দোলন আরও জোরদার হয়। চম্পারণ, যুক্তপ্রদেশ (একা আন্দোলন), মোপলা, বারদৌলি সত্যাগ্রহের মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ কৃষক আন্দোলন এই সময়ে হয়েছিল। সর্বভারতীয় কিষাণ সভাও তৈরি হয় কৃষকদের দাবিদাওয়া তুলে ধরার জন্য।

একইভাবে, শ্রমিকদের অবস্থাও খুব খারাপ ছিল। কম মজুরি, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে লম্বা সময় ধরে কাজ করতে হতো তাদের। তারাও ধীরে ধীরে নিজেদের অধিকারের জন্য লড়তে শুরু করে, ধর্মঘট করে। স্বদেশি আন্দোলনের সময় থেকে শ্রমিক আন্দোলন জোরদার হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর শ্রমিকদের সমস্যা আরও বাড়ে, আন্দোলনও বাড়ে। এই সময়েই সারা ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস (AITUC) তৈরি হয়। জাতীয় কংগ্রেস প্রথমে শ্রমিকদের ব্যাপারে তেমন ভাবেনি, কিন্তু পরে তাদের সমর্থন জানায়, যদিও সবসময় দ্বিধা ছিল। বামপন্থী দলগুলো শ্রমিকদের সংগঠিত করতে বড় ভূমিকা নেয়। ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টি তৈরি হয়। মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার মতো ঘটনায় সরকার বামপন্থী নেতাদের দমন করার চেষ্টা করে।

এই সময়েই রাশিয়ান বিপ্লবের প্রভাবে এবং কংগ্রেসের কিছু নীতির প্রতি হতাশ হয়ে ভারতে বামপন্থী রাজনীতির জন্ম হয়। মানবেন্দ্রনাথ রায়, জওহরলাল নেহরু, সুভাষচন্দ্র বসুর মতো নেতারা সমাজতন্ত্রের আদর্শে প্রভাবিত হন। কমিউনিস্ট পার্টি, কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল, ফরওয়ার্ড ব্লকের মতো দল তৈরি হয়। এরা কৃষক আর শ্রমিকদের দাবিদাওয়া নিয়ে লড়াই করে এবং দেশের স্বাধীনতার পাশাপাশি সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির কথাও বলে। যদিও কৃষক আর শ্রমিক আন্দোলন জাতীয় আন্দোলনের অংশ হয়েছিল, কিন্তু কংগ্রেস বা বামপন্থী দলগুলো সবসময় তাদের সব দাবি পূরণ করতে পারেনি বা তাদের পুরোপুরি আপন করে নেয়নি, যার ফলে কিছু দূরত্বও তৈরি হয়েছিল।

পাঠ্য প্রশ্ন ও উত্তর (Prantik textbook)

সঠিক উত্তরটি নির্বাচন করো

(ক) জৌনপুর ও প্রতাপগড় জেলায় কৃষক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন-

(i) বিনয় সিং পথিক
(ii) বাবা রামচন্দ্র
(iii) বীরেন্দ্র শাসমল
(iv) সোমেশ্বরপ্রসাদ চৌধুরি

উত্তর: (ii) বাবা রামচন্দ্র

(খ) মাদারি পাসি নেতৃত্ব দেন-

(i) মোপলা আন্দোলনে
(ii) বারদৌলি সত্যাগ্রহে
(iii) একা আন্দোলনে
(iv) গুন্টুর জেলার কৃষক আন্দোলনে।

উত্তর: (iii) একা আন্দোলনে

(গ) ‘আমাদের শ্রমিক সমস্যা’ গ্রন্থটির রচয়িতা হলেন-

(i) সুব্রহ্মণ্যম আইয়ার
(ii) সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়
(iii) মুজফফর আহমেদ
(iv) দেওয়ান চমনলাল।

উত্তর: (i) সুব্রহ্মণ্যম আইয়ার

(ঘ) ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে লোকমান্য তিলকের কারাদণ্ডের প্রতিবাদে টানা ছয়দিন হরতাল পালন করে-

(i) কলকাতার শ্রমিক শ্রেণি
(ii) তামিলনাড়ুর শ্রমিক শ্রেণি
(iii) বোম্বাইয়ের শ্রমিক শ্রেণি
(iv) আসামের চা বাগানের শ্রমিক শ্রেণি।

উত্তর: (iii) বোম্বাইয়ের শ্রমিক শ্রেণি

(ঙ) ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল-

(i) সশস্ত্র আন্দোলন পরিচালনা করা
(ii) সাম্যবাদী ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তোলা
(iii) কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলা
(iv) শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তোলা।

উত্তর: (ii) সাম্যবাদী ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তোলা

(চ) একা আন্দোলনের নেতা ছিল-

(i) মাদারি পাসি
(ii) ড. আম্বেদকর
(iii) মহাত্মা গান্ধি
(iv) বাবা রামচন্দ্র

উত্তর: (i) মাদারি পাসি

নীচের বিবৃতিগুলির মধ্যে কোটি ঠিক কোন্‌টি ভুল লেখো

(ক) গান্ধিজি একা আন্দোলনকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছিলেন।

উত্তর: ভুল

কারণ: একা আন্দোলন অহিংস অসহযোগের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হওয়ায় গান্ধিজি এই আন্দোলনকে সমর্থন জানাননি।

(খ) মোপলা আন্দোলনের সঙ্গে খিলাফৎ নেতারা যুক্ত হয়েছিলেন।

উত্তর: ঠিক

কারণ: ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে মানজেরি সম্মেলনের পর মোপলাদের ক্ষোভ ও অসন্তোষের সঙ্গে খিলাফৎ নেতারা যুক্ত হন এবং বিভিন্ন সভায় মোপলা কৃষকদের অভাব-অভিযোগ তুলে ধরে আন্দোলনে গতি সঞ্চার করেন।

(গ) জাতীয়তাবাদী নেতারা কারখানা আইন প্রবর্তনের সপক্ষে ছিলেন।

উত্তর: ভুল

কারণ: সমকালীন জাতীয়তাবাদী নেতারা কারখানা আইনের সমালোচনা করেন এবং শ্রমিকদের কাজের সীমা বেঁধে দেওয়ারও বিরোধী ছিলেন, কারণ তাঁরা মনে করতেন এটি ব্রিটিশ শিল্পপতিদের স্বার্থরক্ষা করবে ও ভারতের শিল্পোন্নয়নে বাধা দেবে।

(ঘ) ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে সর্ব ভারতীয় ট্রেড ইউনিয়ন গঠিত হয়েছিল।

উত্তর: ঠিক

কারণ: ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে প্রথম সর্বভারতীয় ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন (All India Trade Union Congress) বা AITUC গঠিত হয়, যার সভাপতি ছিলেন লালা লাজপত রায়।

(ঙ) আদর্শগত ও নীতিগত প্রশ্নে জাতীয় কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থী ও বামপন্থী নেতাদের মধ্যে কোনো মতানৈক্য ছিল না।

উত্তর: ভুল

কারণ: ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে আদর্শগত ও নীতিগত প্রশ্নে জাতীয় কংগ্রেসের ভিতর দক্ষিণপন্থী ও বামপন্থীদের মধ্যে মতানৈক্য প্রবল হয়ে উঠেছিল, যার ফলে সুভাষচন্দ্র বসু কংগ্রেস সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দেন।

নীচের বিবৃতির সঙ্গে সবচেয়ে মানানসই ব্যাখ্যাটি বেছে নাও

(ক) জাতীয় কংগ্রেসের নেতারা কখনই কৃষক আন্দোলনকে সম্পূর্ণভাবে সমর্থন জানাননি।

ব্যাখ্যা-

(i) কৃষক আন্দোলনকে তাঁরা জাতীয় আন্দোলনের অংশ করতে চাননি
(ii) তারা ভাবতেন শ্রেণিসংগ্রামের পক্ষ নিলে জাতীয়তাবাদী ঐক্য নষ্ট হবে।
(iii) কৃষকদের চরমপন্থী আন্দোলনকে অহিংস পন্থায় বিশ্বাসী নেতারা সমর্থন করতে পারেননি।

উত্তর: ব্যাখ্যা- (ii) তারা ভাবতেন শ্রেণিসংগ্রামের পক্ষ নিলে জাতীয়তাবাদী ঐক্য নষ্ট হবে।

(খ) প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে শ্রমিক আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে।

ব্যাখ্যা-

(i) এই সময় জাতীয়তাবাদী নেতারা শ্রমিক আন্দোলনে নেতৃত্বদান করেন।
(ii) জাতীয় কংগ্রেস শ্রমিক আন্দোলনকে জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করে।
(iii) যুদ্ধের পর আর্থিক মন্দার কারণে শ্রমিক শ্রেণি চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়।

উত্তর: ব্যাখ্যা- (iii) যুদ্ধের পর আর্থিক মন্দার কারণে শ্রমিক শ্রেণি চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়।

(গ) শ্রমজীবী মানুষের কাছে বামপন্থী মতবাদ জনপ্রিয়তা লাভ করে—

ব্যাখ্যা-

(i) বামপন্থীরা সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করে।
(ii) বামপন্থীরা শ্রমজীবীদের জাতীয় আন্দোলনের অংশ করে তোলে
(iii) শোষিত শ্রেণির মুক্তির প্রশ্নে বামপন্থীরা সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তোলে।

উত্তর: ব্যাখ্যা- (iii) শোষিত শ্রেণির মুক্তির প্রশ্নে বামপন্থীরা সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তোলে।

প্রদত্ত ভারতবর্ষের মানচিত্রে নিম্নলিখিত স্থানগুলি চিহ্নিত করো

(ক) ডান্ডি
(খ) বারদৌলি
(গ) চৌরিচৌরা
(ঘ) ‘কীর্তি -কিষাণ’ পত্রিকাটি যে শহর থেকে প্রকাশিত হত।

উত্তর: 

বামস্তম্ভের সঙ্গে ডানস্তম্ভ মেলাও
বামস্তম্ভডানস্তম্ভ
(i) মুজফফর আহমেদ(a) সর্বভারতীয় কিষাণ সভা
(ii) এস. এ. ডাঙ্গে(b) বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দল
(iii) এন. জি. রঙ্গা(c) নবযুগ পত্রিকা
(iv) যোগেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়(d) ‘গান্ধি ও লেনিন’ পুস্তিকা

উত্তর:

বামস্তম্ভডানস্তম্ভ
(i) মুজফফর আহমেদ(c) নবযুগ পত্রিকা
(ii) এস. এ. ডাঙ্গে(d) ‘গান্ধি ও লেনিন’ পুস্তিকা
(iii) এন. জি. রঙ্গা(a) সর্বভারতীয় কিষাণ সভা
(iv) যোগেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়(b) বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দল
একটি বাক্যে উত্তর দাও

ক. বিজোলিয়ার জায়গিরদাররা কৃষকদের উপর কত রকমের উপ-কর আরোপ করেছিল?

উত্তর: বিজোলিয়ার জায়গিরদাররা কৃষকের উপর ৮৬টি বিভিন্ন ধরনের উপ-কর আরোপ করেছিল।

খ. কার উদ্যোগে প্রথম যুক্তপ্রদেশ কিষাণ সভা গঠিত হয়?

উত্তর: ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে মদনমোহন মালব্যের উদ্যোগে প্রথম যুক্তপ্রদেশ কিষাণ সভা গঠিত হয়।

গ. কালিপরাজ কাদের বলা হত?

উত্তর: বারদৌলির আদিবাসী দুবলা জনগোষ্ঠীকে কালিপরাজ বা কালো মানুষ বলা হত।

ঘ. কত খ্রিস্টাব্দে কারখানা আইন পাস হয়?

উত্তর: ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ‘কারখানা আইন’ পাস হয়।

ঙ. ‘ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে’ কোম্পানি কার সভাপতিত্বে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে সভা করেছিল?

উত্তর: ‘ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে’ কোম্পানির শ্রমিকরা বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে যে সভার আয়োজন করে, চিত্তরঞ্জন দাশ সেই সভায় সভাপতিত্ব করেন।

চ. কার নেতৃত্বে কোন্ রাজ্যের শ্রমিকরা প্রথম মে-দিবস উদ্যাপন করেছিলেন?

উত্তর: ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে মাদ্রাজের শ্রমিকরা সিঙ্গারাভেলুর নেতৃত্বে প্রথম মে দিবস উদযাপন করে।

ছ. কত খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে ‘নিখিল ভারত শ্রমিক সমিতি’ কংগ্রেস প্রার্থীকে সমর্থন জানিয়েছিল?

উত্তর: ১৯৩৭-এর নির্বাচনে ‘নিখিল ভারত শ্রমিক সমিতি’ কংগ্রেস প্রার্থীকে সমর্থন জানিয়েছিল।

জ. কে, কোথায় প্রথম ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন?

উত্তর: মানবেন্দ্রনাথ রায় ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ার তাসখন্দে প্রথম ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন।

সংক্ষিপ্ত উত্তরধর্মী প্রশ্ন

ক. বাবা রামচন্দ্র পরিচালিত কৃষক আন্দোলনকে গান্ধিজি শেষ পর্যন্ত সমর্থন জানাননি কেন?

উত্তর: বাবা রামচন্দ্র পরিচালিত কৃষক আন্দোলন সহিংস রূপ ধারণ করলে এবং অহিংস অসহযোগের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হওয়ায় কংগ্রেস নেতৃত্ব তথা গান্ধিজি এই আন্দোলনকে সমর্থন জানাননি।

খ. ‘একা আন্দোলন’ সংগঠিত হওয়ার পিছনে কী কারণ ছিল?

উত্তর: নির্ধারিত খাজনার চেয়ে প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ অতিরিক্ত খাজনা আদায়, ইজারাপ্রাপ্ত ঠিকাদারদের অত্যাচার এবং উৎপাদিত ফসলের একাংশ খাজনা হিসাবে দেওয়ার প্রতিবাদে অযোধ্যার হরদই, বাহরাইচ, বরাবাঁকি ও সীতাপুর জেলার কৃষকরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে, যার ফলে ‘একা আন্দোলন’ সংগঠিত হয়।

গ. গান্ধিজি কালিপরাজদের সম্পর্কে অনুসন্ধান করে কী জানতে পেরেছিলেন?

উত্তর: গান্ধিজি অনুসন্ধান করে জানতে পেরেছিলেন যে বারদৌলির ৬০ শতাংশ মানুষ ছিল আদিবাসী দুবলা জনগোষ্ঠীর, যাদের কালিপরাজ বা কালো মানুষ বলা হত। এরা ছিল সমাজের পিছিয়ে পড়া অনুন্নত শ্রেণি এবং উচ্চবর্ণের পাতিদার বা ভূস্বামীরা ‘উজালি পরাজ’ বলে পরিচিত ছিলেন। অনুসন্ধানে আরও হালি প্রথা (বংশানুক্রমে শ্রমদান), মহাজনদের শোষণ, এবং উচ্চবর্ণের অত্যাচারের বাস্তব চিত্র উঠে আসে। এই সামাজিক বৈষম্য গান্ধিজিকে ব্যথিত করে।

ঘ. বিশ শতকের তিরিশ দশকে বিশ্বব্যাপী আর্থিক মন্দা কৃষক সমাজের উপর কী প্রভাব ফেলেছিল?

উত্তর: বিশ শতকের তিরিশ দশকে ১৯২৯-৩০ খ্রিস্টাব্দ থেকেই বিশ্বব্যাপী আর্থিক মন্দার প্রভাব ভারতে এসে পড়ে। অর্থনৈতিক মন্দার ফলে কৃষিজ পণ্যের দাম কমে যায় এবং কৃষকদের রাজস্ব ও ঋণের বোঝা বৃদ্ধি পায়। এই অবস্থায় ভারতীয় কৃষকদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।

ঙ. স্বদেশি আন্দোলনের সময় শ্রমিক আন্দোলনের চরিত্রে কী পরিবর্তন দেখা যায়?

উত্তর: স্বদেশি আন্দোলনের সময় শ্রমিক আন্দোলনের চরিত্রের পরিবর্তন হয়। এই সময় শ্রমিক আন্দোলন আর শুধুমাত্র অর্থনৈতিক দাবিদাওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং জাতীয় আন্দোলনে শ্রমিকদের শামিল করা হয়। এর ফলে শ্রমিকদের জাতীয় চেতনার বিকাশ ঘটে এবং তারা উপলব্ধি করে যে জাতীয় আন্দোলনের সফলতার সঙ্গেই শ্রমিকদের ভাগ্য জড়িত।

চ. ঐতিহাসিক সুমিত সরকার কোন্ শ্রমিক ধর্মঘটকে প্রকৃত অর্থে রাজনৈতিক ধর্মঘট বলে উল্লেখ করেছেন?

উত্তর: ঐতিহাসিক সুমিত সরকার ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে লোকমান্য তিলকের কারাদণ্ডের প্রতিবাদে বোম্বাইয়ের শ্রমিক শ্রেণির ছয়দিন ধরে পালন করা হরতাল বা ধর্মঘটকে ‘প্রকৃত অর্থে রাজনৈতিক ধর্মঘট’ বলে উল্লেখ করেছেন।

ছ. ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে চা-বাগিচার শ্রমিকরা কেন আসাম ছেড়ে পালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল?

উত্তর: ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে আসামের চা-বাগিচার কর্মীরা বাগিচা-মালিকদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। তারা বিশ্বাস করত গান্ধি স্বরাজ এসে গেলে তাদের দুঃখের দিনের অবসান হবে। ভারতে গান্ধিরাজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এই ভেবে তারা আসাম ছেড়ে পালানোর সিদ্ধান্ত নেয়।

জ. কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলের মূল উদ্দেশ্য কী ছিল?

উত্তর: কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল কংগ্রেসের ভিতরে বামপন্থী শক্তিকে সুদৃঢ় করা, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনকে শক্তিশালী করা এবং শ্রমিক ও কৃষকদের সঙ্গে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ গণ-আন্দোলন সংগঠিত করা।

বিশ্লেষণধর্মী প্রশ্ন

ক. মোপলা কৃষকদের আন্দোলনকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে খিলাফৎ নেতারা কী ভূমিকা পালন করেছিলেন?

উত্তর: অসহযোগ আন্দোলনের সময় ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে মোপলা আন্দোলন নতুন রূপে সংগঠিত হয়। কৃষককল্পরাজ্য গঠনের স্বপ্ন এবং গান্ধিজির অসহযোগ ও খিলাফৎ আন্দোলনের প্রভাব মোপলা বিদ্রোহকে গণ-আন্দোলনের চরিত্র প্রদান করে। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে মানজেরি সম্মেলনের পর মোপলাদের ক্ষোভ ও অসন্তোষের সঙ্গে খিলাফৎ নেতারা যুক্ত হন। তাঁরা বিভিন্ন সভায় মোপলা কৃষকদের অভাব-অভিযোগ তুলে ধরে আন্দোলনে গতি সঞ্চার করেন। মোপলা-খিলাফৎদের এই আন্দোলন ক্রমশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। এই ক্রমবর্ধমান আন্দোলনের প্রসারে ভীত সরকার খিলাফৎ সভার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে এবং বিশিষ্ট খিলাফৎ ও কৃষক নেতাদের গ্রেফতার করা হয়।

খ. আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে বামপন্থীরা কৃষক আন্দোলনকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন?

উত্তর: আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে কৃষকদের আন্দোলনগুলির ক্ষেত্রে কংগ্রেস কর্তৃপক্ষ কোনো ইতিবাচক অবস্থান গ্রহণ করতে পারেনি। কৃষকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলনে যোগদান করলেও কংগ্রেস কর্তৃপক্ষের দ্বারা কৃষকদের অনুকূলে কোনো জাতীয় কর্মসূচি গড়ে তোলা হয়নি। ফলে একপ্রকার আশাহত হয়েই বামপন্থী রাজনীতিবিদরা কৃষকদের সংগঠিত করতে উদ্যত হন। বিহারে স্বামী সহজানন্দ সরস্বতীর নেতৃত্বে বিহার প্রাদেশিক কৃষক সভা গড়ে ওঠে এবং ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে এই অঞ্চলের কৃষকরা জমিদারি উচ্ছেদের কর্মসূচি গ্রহণ করে, যাতে বহু সংখ্যক কৃষক যোগদান করে। একই সময়ে অন্ধপ্রদেশ, ওড়িশা প্রভৃতি রাজ্যেও আন্দোলন সংগঠিত হয়। এই পর্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল ১৯৩৬ সালের এপ্রিল মাসে কংগ্রেসের লখনউ অধিবেশনে সর্বভারতীয় কিষাণ সভার প্রতিষ্ঠা, যেখানে বামপন্থী মতাদর্শে বিশ্বাসী নেতারা সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেন। কিষাণ সভার প্রথম সভাপতি হন কৃষকনেতা এন. জি. রঙ্গ এবং সম্পাদক হন সহজানন্দ সরস্বতী। আগস্ট মাসে প্রকাশিত কিষাণ ইস্তাহারে জমিদারি ব্যবস্থার উচ্ছেদ, ভূমিরাজস্বের হার অর্ধেক হ্রাস করা, বেগার প্রথার অবসান এবং অরণ্য সম্পদের ওপর কৃষকের স্বীকৃতির দাবি জানানো হয়। কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে বিভিন্ন সভা-সমিতি ও মিছিল করা হয় এবং বিহার প্রদেশে ‘বখস্ত’ জমিকে কেন্দ্র করে কিষাণ সভা জোরালো আন্দোলন গড়ে তোলে। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে নিখিল ভারত কিষাণ সভার শাখা স্থাপিত হয়।

গ. কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে জাতীয় কংগ্রেসের নেতারা কী মনোভাব পোষণ করতেন?

উত্তর: জাতীয় কংগ্রেস পরিকল্পিত ভাবে কৃষকের উন্নয়নমূলক কোনো কর্মসূচি সে অর্থে গ্রহণ করতে পারেনি, যদিও জাতীয় নেতাদের আহ্বানে কৃষকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাড়া দিয়েছিল। কৃষকদের আন্দোলনগুলির ক্ষেত্রে কংগ্রেস কর্তৃপক্ষ কোনো ইতিবাচক অবস্থান গ্রহণ করতে পারেনি এবং কৃষকদের অনুকূলে কোনো জাতীয় কর্মসূচিও গড়ে তোলা হয়নি। বলাবাহুল্য জাতীয় কংগ্রেস কখনই কৃষক আন্দোলনকে সম্পূর্ণভাবে সমর্থন জানায়নি। তাদের ধারণা ছিল কৃষকদের পক্ষ নিলে জমিদার শ্রেণি কংগ্রেস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, যাতে জাতীয়তাবাদী ঐক্য নষ্ট হতে পারে। তাই একটা পর্যায় পর্যন্ত তারা কৃষক আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছিল। কৃষকদের চরমপন্থী আন্দোলনকে গান্ধিজি সমর্থন জানাননি কারণ তাঁর বক্তব্য ছিল, কৃষক আন্দোলন হিংসাশ্রয়ী হলে সরকার নির্মম অবস্থান গ্রহণ করবে এবং এতে নিরস্ত্র কৃষকদেরই বেশি ক্ষতি হবে। সর্বভারতীয় কিষাণ সভা ও জাতীয় কংগ্রেস কেউই ভারতের ক্ষুদ্র, প্রান্তিক চাষি, বর্গাদার বা ভূমিহীন কৃষকদের অধিকারের জন্য সোচ্চার হয়ে ওঠেনি, এবং জাতীয় আন্দোলন কৃষক সমাজের স্বার্থকে সুরক্ষিত করতে সেই অর্থে সফল হয়নি।

ঘ. টীকা লেখো-ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস্ পার্টি।

উত্তর: ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা হলে শ্রমিকদের মধ্যে এক নতুন চেতনা সঞ্চারিত হয়। সেই বছর নভেম্বর মাসে মুজফ্ফর আহমেদ, হেমন্তকুমার সরকার প্রমুখের নেতৃত্বে ‘লেবার স্বরাজ পার্টি’ গঠিত হয়। বম্বেতে ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে ‘কংগ্রেস লেবার পার্টি’ গঠিত হয়। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে এই সমস্ত প্রাদেশিক সংগঠনগুলি ঐক্যবদ্ধ করে একটি সর্বভারতীয় দল গঠন করা হয়, যার নতুন নামকরণ হয় ‘ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস্ পার্টি’। এই দলের মুখপত্র ছিল ‘লাঙল’ ও ‘গণবাণী’ পত্রিকা। এর সভাপতি ও সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে সোহং সিং যোশ এবং আর. এস. নিম্বলকার। কলকাতায় অনুষ্ঠিত এই দলের সর্বভারতীয় সমাবেশে প্রায় ৫০,০০০ শ্রমিক ও সাধারণ মানুষ অংশ নেয় এবং বিপুল সাড়া জাগায়। এই সম্মেলনে কিছু বৈপ্লবিক প্রস্তাব গৃহীত হয়, যেমন— শ্রেণি সংগ্রাম, বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথার বিলোপসাধন, শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতন দান ও ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের স্বাধীনতা ইত্যাদি। ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস্ পার্টি শুধুমাত্র শ্রমিকদের অর্থনৈতিক দাবি সংক্রান্ত সংগ্রামের প্রতিই সহানুভূতিশীল ছিল না; এই দলের নেতৃত্ব শ্রমিক-শ্রেণিকে বৃহত্তর রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন।

ঙ. আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে সংগঠিত শোলাপুরের শ্রমিক আন্দোলন সম্পর্কে লেখো।

উত্তর: ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ৬ এপ্রিল লবণ সত্যাগ্রহের মাধ্যমে আইন অমান্য আন্দোলনের সূচনা হয়। এই সময় মহারাষ্ট্রের শোলাপুরে একটি উল্লেখযোগ্য শ্রমিক অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটে। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ৭ মে গান্ধিজির গ্রেফতারের খবর শুনে শোলাপুর বস্ত্রশিল্পের শ্রমিকরা ধর্মঘট করে। শ্রমিক প্রতিবাদ ক্রমশ চরম রূপ ধারণ করে এবং থানা, রেলস্টেশন, আদালত সর্বত্র আক্রমণ চালানো হয়। সরকার নির্মম দমন-পীড়ন চালিয়ে আন্দোলন প্রতিহত করে। তবে এই আন্দোলনগুলি ছিল বিচ্ছিন্ন। এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে, বামপন্থীরা আইন অমান্য আন্দোলনে যোগদান করেনি এবং তাদের নির্দেশে বেশিরভাগ শ্রমিকরাও এই আন্দোলনে নিশ্চেষ্ট থাকে।

চ. টীকা লেখো-মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা।

উত্তর: শ্রমিকদের মধ্যে বামপন্থীদের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ব্রিটিশ সরকারকে উদ্বিগ্ন করে তোলে। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে ব্যাপক শ্রমিক অসন্তোষের আশঙ্কা করে সরকার ৩১ জন বামপন্থী নেতাকে গ্রেফতার করে। এঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয় যে, তাঁরা ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছে। এই মামলাই মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা নামে পরিচিত। মীরাট ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত নেতাদের মধ্যে ছিলেন এস. এ. ডাঙ্গে, মুজফফর আহমেদ, পি. সি. যোশী, আর. এস. নিম্বকর প্রমুখ। ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার রায় ঘোষিত হয় এবং অধিকাংশ অভিযুক্ত দোষী সাব্যস্ত হয়ে দীর্ঘ কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। জওহরলাল নেহরু বন্দী কমিউনিস্ট নেতাদের পক্ষ নেন। এই মামলা বিশ্বের নজর কাড়ে এবং সারা পৃথিবীর গণ্যমান্য ব্যক্তি যেমন আইনস্টাইন, রোমাঁ রোলাঁ, এইচ. জি. ওয়েলস্ এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানান।

ছ. ভারত ছাড়ো আন্দোলনে শ্রমিক শ্রেণির যোগদান কীরূপ ছিল?

উত্তর: ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে বামপন্থীরা যোগ দেয়নি এবং শ্রমিক শ্রেণির প্রতিও কোনো ধর্মঘট বা আন্দোলন না করার নির্দেশ ছিল। তবে কিছু ক্ষেত্রে শ্রমিকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অংশ হিসাবে যোগদান করে। ৯ আগস্ট গান্ধিজি ও কংগ্রেস নেতারা গ্রেফতার হলে দেশজোড়া প্রতিবাদে শ্রমিকরাও শামিল হয়। দিল্লি, লখনউ, কানপুর, বম্বে, নাগপুর, আমেদাবাদ, ব্যাঙ্গালোর, মাদ্রাজের শ্রমজীবী মানুষরা এক সপ্তাহব্যাপী ধর্মঘট করে। জামসেদপুরে টাটা ইস্পাত কারখানা ১৩ দিন বন্ধ থাকে।

জ. বামপন্থী গোষ্ঠী উদ্ভবের জাতীয় পটভূমি কী ছিল বলে তোমার মনে হয়?

উত্তর: ভারতে বামপন্থী বা সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা দ্রুত প্রসারিত হওয়ার একটি প্রধান কারণ ছিল অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার। চৌরিচৌরার ঘটনার পর গান্ধিজি মাঝপথে আন্দোলন বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিলে সক্রিয় স্বাধীনতা সংগ্রামীরা হতাশ হয়ে পড়েন এবং গান্ধিজির রাজনৈতিক আদর্শ ও কর্মপন্থার উপর আস্থা হারান। এই সময় সারা দেশজুড়ে সমাজতান্ত্রিক ও বামপন্থী গোষ্ঠী গড়ে উঠতে থাকে। শ্রমিক শ্রেণির কাছে সমাজতান্ত্রিক মত ও পথ ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠায় ব্রিটিশ সরকার আতঙ্কিত হয়ে ওঠে এবং এই বৈপ্লবিক ভাবধারাকে স্তব্ধ করতে কঠোর দমননীতি অনুসরণ করে মুজফফর আহমেদ, ডাঙ্গে, নলিনী গুপ্ত প্রমুখ নেতাদের গ্রেফতার করে। কিন্তু এতেও বামপন্থীদের দমন করা সম্ভব হয়নি; তারা সভা-সমিতি, মিছিল এবং বিভিন্ন পুস্তিকা-পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে সাম্যবাদী ধ্যানধারণা ছড়াতে থাকে। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে কানপুরে সম্মেলনের মাধ্যমে ‘ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি’ গঠিত হয়, যার উদ্দেশ্য ছিল সাম্যবাদী ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তোলা। এছাড়া, বিশ শতকের তিনের দশকে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা এবং তার ফলে উদ্ভূত বেকার সমস্যা ও পুঁজিবাদী শোষণে বিপর্যস্ত মানুষও সমাজতন্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হয়, যা বামপন্থী গোষ্ঠীর উদ্ভবের জাতীয় পটভূমির অংশ ছিল।

ব্যাখ্যাধর্মী প্রশ্ন

ক. অসহযোগ আন্দোলন পর্বে গড়ে ওঠা কৃষক আন্দোলন গুলির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও। এই আন্দোলনগুলি কি শেষ পর্যন্ত অহিংস অসহযোগের পথে টিকে থাকতে পেরেছিল?

উত্তর: গান্ধিজির অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের সময়ে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে কৃষক আন্দোলন হয়। প্রাথমিকভাবে রাজনীতির প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই আন্দোলনগুলির সূচনা হয়েছিল। পরবর্তীকালে জাতীয় কংগ্রেসের হস্তক্ষেপে ও অসহযোগ আন্দোলনের প্রভাবে সেগুলি বৃহত্তর জাতীয় চরিত্র লাভ করে। এই পর্বের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কৃষক আন্দোলন হল:

  • যুক্তপ্রদেশের কৃষক আন্দোলন: অসহযোগ আন্দোলনের সময় যুক্তপ্রদেশ কৃষক বিদ্রোহের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে ওঠে। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে মদনমোহন মালব্যের উদ্যোগে প্রথম যুক্তপ্রদেশ কিষাণ সভা গঠিত হয়। জৌনপুর ও প্রতাপগড় জেলা বাবা রামচন্দ্রের নেতৃত্বে অযোধ্যার তালুকদার বা বৃহৎ ভূস্বামীদের আর্থিক শোষণের বিরুদ্ধে কৃষকরা সংগঠিত হয়। তাঁর উদ্যোগে জওয়াহরলাল নেহরু উত্তরপ্রদেশ কিষাণ সভা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯২০-র ১৭ অক্টোবর অসহযোগের সমর্থকরা বিকল্প কিষাণ সভা গঠন করেন। নতুন সংগঠন বিগত কয়েক মাস ধরে উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন জেলায় তৃণমূল স্তরে গড়ে ওঠা কিষাণ সভাগুলিকে একই পতাকার তলে নিয়ে আসে। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ২১ ডিসেম্বর নবগঠিত কিষাণ সভা অযোধ্যায় প্রায় এক লক্ষ কৃষকের সমাবেশের আয়োজন করে। ১৯২১ থেকে এই আন্দোলন সহিংস রূপ ধারণ করলে ইংরেজ সরকার দমন-পীড়নের মাধ্যমে তাকে প্রতিহত করে। রামচন্দ্র-সহ বহু নেতা গ্রেফতার হন। আন্দোলন অহিংস অসহযোগের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হওয়ায় কংগ্রেস নেতৃত্ব তথা গান্ধিজি এই আন্দোলনকে সমর্থন জানাননি।
  • একা আন্দোলন (১৯২১-২২): স্থানীয় কংগ্রেস ও খিলাফৎ নেতাদের নেতৃত্বে অযোধ্যার হরদই, বাহরাইচ, বরাবাঁকি ও সীতাপুর জেলায় ‘একা’ আন্দোলন শুরু হয়। নির্ধারিত খাজনার চেয়ে প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ অতিরিক্ত খাজনা আদায়, ইজারাপ্রাপ্ত ঠিকাদারদের অত্যাচার এবং উৎপাদিত ফসলের একাংশ খাজনা হিসাবে দেওয়ার প্রতিবাদে এই অঞ্চলের কৃষকরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। এই ‘একা’ সভায় সমবেত কৃষকরা শপথ নেয় যে, তারা নির্ধারিত খাজনার বাইরে আর কোনো খাজনা দেবে না, বেগার শ্রম দিতে স্বীকৃত হবে না এবং পঞ্চায়েতের সিদ্ধান্ত মেনে চলবে। মূল দাবি ছিল পণ্যের পরিবর্তে নগদ টাকায় খাজনা দেওয়া। ক্রমশ এই আন্দোলনের নেতৃত্ব চরমপন্থী নেতা মাদারি পাসির হাতে চলে যায়। অসহযোগ ও খিলাফৎ আন্দোলনে যে অহিংস পন্থা গ্রহণ করা হয়েছিল একা আন্দোলনের নেতারা তা অনুসরণ করেননি। ফলে জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে এই আন্দোলনের যোগাযোগ ক্রমশ কমে আসে। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে জুন মাসে মাদারি পাসি গ্রেফতার হন এবং ইংরেজ সরকার প্রচণ্ড নিপীড়ন চালিয়ে এই আন্দোলন দমন করে।
  • মোপলা আন্দোলন (১৯২১): দক্ষিণ ভারতের মালাবার অঞ্চলের মোপলা কৃষকরা জমিদারদের আর্থিক শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল। অসহযোগ আন্দোলনের সময় ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে এই আন্দোলন নতুন রূপে সংগঠিত হয়। কৃষককল্পরাজ্য গঠনের স্বপ্ন এবং গান্ধিজির অসহযোগ ও খিলাফৎ আন্দোলনের প্রভাব মোপলা বিদ্রোহকে গণ-আন্দোলনের চরিত্র প্রদান করে। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে মানজেরি সম্মেলনের পর মোপলাদের ক্ষোভ ও অসন্তোষের সঙ্গে খিলাফৎ নেতারা যুক্ত হন। এই ক্রমবর্ধমান আন্দোলনের প্রসারে ভীত সরকার খিলাফৎ সভার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে এবং বিশিষ্ট খিলাফৎ ও কৃষক নেতাদের গ্রেফতার করা হয়। এই ঘটনায় বিদ্রোহীরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে হিংসাত্মক আন্দোলনের পথে অগ্রসর হয়। সরকার নিষ্ঠুর দমননীতি প্রয়োগ করে হাজার হাজার মোপলা কৃষককে হত্যা করে। মোপলারা হিংসাশ্রয়ী পথ অবলম্বন করায় অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গেও তাদের সম্পর্কে ফাটল ধরে এবং জাতীয় আন্দোলনের থেকে বিচ্যুত হয়ে বিদ্রোহের পথ পরিত্যাগ করে।
  • অন্যান্য আন্দোলন: এই উল্লেখযোগ্য কৃষক আন্দোলনগুলি ছাড়াও ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ছোটো বড়ো অসংখ্য কৃষক আন্দোলন সংগঠিত হয়। যেমন—সোমেশ্বরপ্রসাদ চৌধুরির নেতৃত্বে রাজশাহি-নদিয়া ও পাবনা-মুরশিদাবাদ সীমান্তের কৃষক আন্দোলন, বীরেন্দ্রনাথ শাসমলের নেতৃত্বে মেদিনীপুর জেলার কাঁথি ও তমলুকে ইউনিয়ন বোর্ড বিরোধী কৃষক আন্দোলন, দক্ষিণ ভারতে অন্ধ্রের গুন্টুর জেলার কৃষক আন্দোলন, অন্ধ্রপ্রদেশের রাম্পা জনগোষ্ঠীর আন্দোলন প্রভৃতি।

অসহযোগ আন্দোলনের সমকালীন কৃষক আন্দোলনগুলি প্রায় সবকটিই অতিরিক্ত রাজস্ব এবং জমিদারি অত্যাচারের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিল এবং সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার পথে অগ্রসর হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অহিংস আন্দোলনের পথে টিকে থাকতে না পেরে বেশিরভাগ আন্দোলনই অসহযোগ আন্দোলনের মতাদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়, ফলে জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ফিকে হয়ে আসে।

খ. বারদৌলি আন্দোলনে গান্ধিজির অহিংস সত্যাগ্রহের আদর্শ রক্ষিত হয়েছিল—এই মন্তব্যের আলোকে বারদৌলি আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করো। এই আন্দোলন কি সফল হয়েছিল?

উত্তর: গান্ধিজির অহিংস সত্যাগ্রহের সফল প্রতিফলন ঘটেছিল ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের বারদৌলি সত্যাগ্রহ আন্দোলনে। এই আন্দোলন ছিল অসহযোগ দিনগুলির ফসল, কারণ গান্ধিবাদী নেতারা অসহযোগ আন্দোলনের মতাদর্শ এই অঞ্চলে প্রচার করেছিলেন। বারদৌলির ৬০ শতাংশ মানুষ ছিল আদিবাসী দুবলা জনগোষ্ঠীর, যাদের ‘কালিপরাজ’ বা কালো মানুষ বলা হত। এরা ছিল সমাজের পিছিয়ে পড়া অনুন্নত শ্রেণি এবং উচ্চবর্ণের পাতিদার বা ভূস্বামীরা ‘উজালি পরাজ’ বলে পরিচিত ছিলেন। এই সামাজিক বৈষম্য গান্ধিজিকে ব্যথিত করে। বার্ষিক কালিপরাজদের সম্মেলনে (১৯২২, ১৯২৭ খ্রি.) গান্ধিজি সম্মানহানিকর কালিপরাজ বা কালো মানুষ নাম বদলে রাখেন ‘রানিপরাজ’ বা অরণ্যবাসী। তাঁর নির্দেশে সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি গৃহীত হয় এবং তিনি এই অঞ্চলের পিছিয়ে পড়া শ্রেণি সম্পর্কে অনুসন্ধান শুরু করেন। অনুসন্ধানে হালি প্রথা (বংশানুক্রমে শ্রমদান), মহাজনদের শোষণ, উচ্চবর্ণের অত্যাচারের বাস্তব চিত্র উঠে আসে। ক্রমশ কংগ্রেস এই অঞ্চলে প্রভাবশালী হয়ে ওঠে এবং পিছিয়ে পড়া মানুষদের উন্নতিসাধনে কংগ্রেস নেতৃত্ব এগিয়ে আসে।

১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে সরকার ২২ শতাংশ রাজস্ব বৃদ্ধির হার ঘোষণা করলে তা পাতিদার বা ভূস্বামীদের স্বার্থে আঘাত হানে। ১৯২৭-এর সেপ্টেম্বর মাসে পাতিদারদের সম্মেলনে গান্ধিজি ও বল্লভভাই প্যাটেলের উদ্যোগে ওই অঞ্চলে খাজনা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বল্লভভাই প্যাটেল এবং স্থানীয় নেতারা পাতিদার এবং আদিবাসী কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য স্থাপনে উদ্যোগী হয়ে ওঠেন। এই উদ্দেশ্যে জাতিগত অবস্থান, সামাজিক বয়কট, ধর্মীয় আবেদন, ভজন, গান প্রভৃতিকে কৌশলে ব্যবহার করা হয়। গান্ধিজির মতাদর্শ ও ভাবমূর্তি প্রচারে নানান আধ্যাত্মিক প্রসঙ্গের আশ্রয় নেওয়া হয়। কিছুদিনের মধ্যেই বারদৌলি জাতীয় বিষয়ে পরিণত হয়।

প্রথমে ইংরেজ সরকার এই আন্দোলন দমন করার জন্য পুলিশ ও সামরিক বাহিনী পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু পরে তা থেকে সরে আসে কারণ সরকারের কাছে খবর ছিল বারদৌলি আন্দোলন দমনে কোনো দমন-পীড়নমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে কমিউনিস্টরা পরিস্থিতি কাজে লাগিয়ে রেল ধর্মঘট সংগঠিত করবে। তাই সরকার ঘটনাবলি অনুসন্ধানের জন্য ব্লুমফিল্ড-ম্যাক্সওয়েল তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্ত কমিটির সুপারিশে বর্ধিত রাজস্বের হার ২২ শতাংশ থেকে ৬.২৫ শতাংশ করা হয়। রাজস্ব হারের এই পরিবর্তন বারদৌলি আন্দোলনকে সফল করে তোলে। অহিংস পদ্ধতির দ্বারা অর্জিত এই সাফল্যে গান্ধিজির অহিংস সত্যাগ্রহের আদর্শ রক্ষিত হয়।

সুতরাং, বারদৌলি আন্দোলন সফল হয়েছিল। বর্ধিত রাজস্বের হার কমিয়ে ৬.২৫ শতাংশ করায় আন্দোলন তার লক্ষ্যে পৌঁছায় এবং অহিংস পদ্ধতিতে এই সাফল্য গান্ধিজির সত্যাগ্রহের আদর্শকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে।

গ. কৃষক আন্দোলন কখনই ভারতের মুক্তি আন্দোলনের হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারেনি—এই মন্তব্যকে কি তুমি সমর্থন করো? উত্তরের সপক্ষে যুক্তি দাও।

উত্তর: হ্যাঁ, এই মন্তব্যটি বহুলাংশে সমর্থনযোগ্য। বিশ শতকের ভারতে কৃষক আন্দোলন জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হলেও এবং অসহযোগ, আইন অমান্য, ভারত ছাড়ো প্রভৃতি আন্দোলনে কৃষকদের ব্যাপক যোগদান আন্দোলনগুলিকে গণ-আন্দোলনের রূপ দিলেও, কৃষক আন্দোলন সামগ্রিকভাবে ভারতের মুক্তি আন্দোলনের প্রধান হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারেনি। এর সপক্ষে নিম্নলিখিত যুক্তিগুলি দেওয়া যেতে পারে:

  • কংগ্রেসের দ্বিধাগ্রস্ত নীতি: জাতীয় কংগ্রেস পরিকল্পিত ভাবে কৃষকের উন্নয়নমূলক কোনো কর্মসূচি সে অর্থে গ্রহণ করতে পারেনি। যদিও জাতীয় নেতাদের আহ্বানে কৃষকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাড়া দেয়, কংগ্রেস নেতৃত্ব কৃষকদের দাবিদাওয়া নিয়ে পূর্ণাঙ্গ সমর্থন জানাতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। তাদের ধারণা ছিল কৃষকদের পক্ষ নিলে জমিদার শ্রেণি কংগ্রেস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, যা জাতীয়তাবাদী ঐক্যকে নষ্ট করবে। তাই একটা পর্যায় পর্যন্ত তারা কৃষক আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছিল, কিন্তু সম্পূর্ণভাবে নয়।
  • আন্দোলনের সহিংস মোড়: অনেক কৃষক আন্দোলন, যেমন যুক্তপ্রদেশ, একা বা মোপলা আন্দোলন, একসময় অহিংস পথ থেকে সরে গিয়ে সহিংস রূপ ধারণ করে। গান্ধিজি এবং কংগ্রেস নেতৃত্ব হিংসাশ্রয়ী আন্দোলনকে সমর্থন জানাননি, কারণ এতে সরকারের নির্মম দমনের আশঙ্কা ছিল এবং তা অহিংসার আদর্শের পরিপন্থী ছিল। ফলে এই আন্দোলনগুলি জাতীয় নেতৃত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
  • বামপন্থী ও কংগ্রেসের দূরত্ব: তিরিশের দশকে বামপন্থীরা কৃষকদের সংগঠিত করার চেষ্টা করলেও (যেমন, সর্বভারতীয় কিষাণ সভা গঠন), কংগ্রেসের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠে। কংগ্রেস কমিটি সহজানন্দের সভায় কংগ্রেসিদের যাওয়া নিষিদ্ধ করে এবং কংগ্রেস শাসিত প্রদেশে কৃষক আন্দোলন দমনে ১৪৪ ধারাও ব্যবহার করা হয়। এই বিভেদ কৃষক আন্দোলনকে জাতীয় স্তরে দুর্বল করে দেয়।
  • সীমিত লক্ষ্য: প্রাথমিকভাবে কৃষক সমাজ আর্থিক শোষণের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই আন্দোলনের পথে এগিয়েছিল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা তাদের কর্মসূচির প্রথমদিকে অন্তর্ভুক্ত ছিল না। যদিও পরে জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থী নেতাদের হস্তক্ষেপে এই আন্দোলন জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়, তবুও এর মূল লক্ষ্য অনেকসময় স্থানীয় বা অর্থনৈতিক দাবিপূরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে।
  • সংগঠনের অভাব: সর্বভারতীয় কিষাণ সভা ও জাতীয় কংগ্রেস কেউই ভারতের ক্ষুদ্র, প্রান্তিক চাষি, বর্গাদার বা ভূমিহীন কৃষকদের অধিকারের জন্য পূর্ণাঙ্গভাবে সোচ্চার হয়ে ওঠেনি। ফলে কৃষক সমাজের স্বার্থকে জাতীয় আন্দোলনের মূল স্রোতে সুরক্ষিত করা সম্ভব হয়নি।

পরিশেষে বলা যায়, কৃষক আন্দোলন ভারতের মুক্তি আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলেও, নেতৃত্বের দ্বিধা, আন্দোলনের সহিংসতা, সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং সীমিত লক্ষ্যের কারণে এটি কখনই মুক্তি আন্দোলনের প্রধান চালিকাশক্তি বা হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারেনি। এই দুর্বলতা পরবর্তীকালে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বহু সমস্যার জন্ম দিয়েছিল।

ঘ. শ্রমিক আন্দোলন সম্পর্কে জাতীয় কংগ্রেসের অবস্থান কীরূপ ছিল তা আলোচনা করো।

উত্তর: শ্রমিক আন্দোলন সম্পর্কে জাতীয় কংগ্রেসের অবস্থান সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে এবং এর মধ্যে বিভিন্ন সময়ে দ্বিধা ও পরস্পরবিরোধিতা লক্ষ্য করা যায়।

  • প্রাথমিক পর্ব (বিশ শতকের প্রথম দুই দশক): এই সময়ে সমকালীন জাতীয়তাবাদী নেতারা শ্রমিকদের দুরবস্থার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেননি এবং একপ্রকার নীরব দর্শকের ভূমিকাই পালন করেন। তাঁরা এমনকি কারখানা আইনেরও সমালোচনা করেন কারণ তাঁদের ধারণা ছিল এই আইন ব্রিটিশ শিল্পপতিদের স্বার্থরক্ষা করবে এবং ভারতের শিল্পোন্নয়নে বাধা দেবে। তাঁরা শ্রমিকদের কাজের সীমা বেঁধে দেওয়ারও বিরোধী ছিলেন। তবে তাঁরা ইউরোপীয় শিল্পপতি পরিচালিত শিল্পগুলির (চা, পাট, কয়লা) শ্রমিকদের দুরবস্থার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করলেও ভারতীয় পুঁজিপতিদের ক্ষেত্রে শ্রমিক-বিরোধী অবস্থান নেন – যা ছিল এক পরস্পর বিরোধী ভূমিকা। জাতীয় কংগ্রেস কোনো বিশেষ শ্রেণির (যেমন শ্রমিক) স্বার্থের সঙ্গে নিজেকে জড়াতে চায়নি, কারণ তারা মনে করত এতে অন্য শ্রেণি (যেমন মালিক) কংগ্রেসের বিরুদ্ধে চলে যেতে পারে এবং জাতীয় সংহতি নষ্ট হতে পারে। স্বদেশি আন্দোলনের সময় (১৯০৫-০৮) অবশ্য বিপিনচন্দ্র পাল, লালা লাজপত রায় প্রমুখ নেতারা শ্রমিকদের সমর্থনে এগিয়ে আসেন এবং শ্রমিক আন্দোলন জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়।
  • অসহযোগ পর্ব ও পরবর্তীকাল: শ্রমিক আন্দোলনের প্রসার লক্ষ করে জাতীয় কংগ্রেস এই বিষয়ে পূর্বেকার নিরাসক্তভাব কাটিয়ে ওঠে। অমৃতসর কংগ্রেসে (১৯১৯) ভারতীয় শ্রমিকদের মান উন্নয়নের জন্য কংগ্রেস প্রাদেশিক কমিটিগুলিকে নির্দেশ দেওয়া হয়। নাগপুর কংগ্রেসে (১৯২০) সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে ন্যায়সংগত ও বৈধ অধিকার অর্জনের জন্য কংগ্রেস শ্রমিক আন্দোলনকে সমর্থন জানাবে। কিন্তু বাস্তবে কংগ্রেসের মনোভাবে স্পষ্ট ফারাক দেখা যায়। গান্ধিজি আমেদাবাদ শ্রমিক আন্দোলনকে পূর্ণ সমর্থন জানালেও তিনি রাজনৈতিক স্বার্থে শ্রমিক আন্দোলনকে যুক্ত করার ঘোর বিরোধী ছিলেন। অন্যদিকে লালা লাজপত রায়, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, জওহরলাল নেহরু এবং সুভাষচন্দ্র বসু শ্রমিক আন্দোলনকে জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে একত্রিত করতে চান।
  • তিরিশের দশক ও তারপর: আইন অমান্য আন্দোলনে বামপন্থীদের প্রভাবে বেশিরভাগ শ্রমিক অংশ নেয়নি। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের পর গঠিত কংগ্রেস মন্ত্রীসভাগুলি শ্রমিকদের দাবিকে পূর্ণ সমর্থন জানায়নি। বোম্বাইয়ে মন্ত্রীসভা ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে ‘শ্রমবিরোধ আইন’ পাস করে, যা ধর্মঘট নিষিদ্ধ করে এবং বামপন্থীরা এর তীব্র প্রতিবাদ করে। শ্রমিক আন্দোলন প্রশ্নে কংগ্রেসের ভিতরে দক্ষিণপন্থী ও বামপন্থীদের বিরোধ চরমে ওঠে। ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় কংগ্রেস নেতৃত্ব গ্রেফতার হলে শ্রমিকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেয়, যদিও বামপন্থীরা এতে যোগ দেয়নি।

পরিশেষে বলা যায়, জাতীয় কংগ্রেস নেতারা বিশ্বাস করতেন শ্রমিক শ্রেণির সংগ্রামকে জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করলে জাতীয়তাবাদী ঐক্যে ফাটল ধরবে। তাই জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের পরিধির মাঝে শ্রমিক আন্দোলনকে নিয়ে আসার কোনো সুনির্দিষ্ট চেষ্টাই করা হয়নি। কংগ্রেস নেতৃত্বের এই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এবং বামপন্থী আন্দোলনের দুর্বলতার কারণে শ্রমিক আন্দোলন জাতীয় আন্দোলনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে পূর্ণাঙ্গভাবে গড়ে উঠতে পারেনি।

ঙ. বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ভারতের শ্রমিক আন্দোলন এক নতুন যুগে প্রবেশ করে—মন্তব্যটির যথার্থতা বিচার করে এই পর্বে সংঘটিত শ্রমিক আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

উত্তর: হ্যাঁ, মন্তব্যটি যথার্থ। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ভারতের শ্রমিক আন্দোলন বাস্তবিকই এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছিল। এর আগে শ্রমিক আন্দোলন মূলত বিচ্ছিন্ন এবং অসংগঠিত থাকলেও, স্বদেশি আন্দোলনের আবহে তা নতুন মাত্রা পায়। বিপান চন্দ্রের মতে, “শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে স্বদেশি আন্দোলন (১৯০৩-১৯০৮ খ্রিস্টাব্দ) ছিল একটি দিকচিহ্ন।” বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী স্বদেশ ভাবনা এই সময় শ্রমিকদের উদ্বুদ্ধ করে তোলে এবং শ্রমিকদের অসন্তোষ সুস্পষ্ট অভিব্যক্তি লাভ করে। এই সময় শ্রমিক আন্দোলন শুধুমাত্র অর্থনৈতিক দাবিদাওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়। শ্রমিকদের মধ্যে জাতীয় চেতনার বিকাশ ঘটে এবং তারা উপলব্ধি করে যে জাতীয় আন্দোলনের সফলতার সঙ্গেই তাদের ভাগ্য জড়িত। ফলে জাতীয়তাবাদী নেতাদের নেতৃত্বে সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলন গড়ে ওঠে।

এই পর্বে সংঘটিত শ্রমিক আন্দোলনের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল:

  • নেতৃত্ব ও সংগঠন: প্রভাতকুসুম রায়চৌধুরি, অপূর্বকুমার ঘোষ, অশ্বিনীকুমার ব্যানার্জি ও প্রেমতোষ বসুর মতো জাতীয়তাবাদী নেতারা বাংলায় শ্রমিক সংগঠন গড়ে তোলেন। বিপিনচন্দ্র পাল, লালা লাজপত রায়, জি. সুব্রহ্মণ্যম আইয়ার-এর মতো নেতারা শ্রমিকদের সমর্থনে এগিয়ে আসেন।
  • ধর্মঘট ও প্রতিবাদ: ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে ১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গের দিন সারা বাংলা জুড়ে শ্রমিকরা ধর্মঘট করে। হাওড়ার বার্ন কোম্পানির কর্মচারীরা কর্তৃপক্ষের প্রবর্তিত নতুন বিধিনিষেধের প্রতিবাদে ‘ওয়াকআউট’ করে এবং প্রায় ১২ হাজার শ্রমিক ধর্মঘটে যোগ দেয়। কলকাতায় ভারত সরকারের প্রেস, ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে ও পাটকলে ধর্মঘট ডাকা হয়।
  • রেল ধর্মঘট: ‘ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে’ কোম্পানির শ্রমিকরা তাদের বিভিন্ন দাবিদাওয়ার জন্য ও বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে চিত্তরঞ্জন দাশের সভাপতিত্বে এক সভার আয়োজন করে। রেল ধর্মঘটের ফলে যোগাযোগ ব্যাহত হয়, যা ব্রিটিশ শাসনের মর্যাদার ওপর প্রচণ্ড আঘাত হানে।
  • অন্যান্য অঞ্চলের আন্দোলন: একই সময়ে তামিলনাড়ুর তুতিকোরিনে বিদেশি মালিকানাধীন একটি বস্ত্র কারখানায় ধর্মঘট করা হয়। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে পাঞ্জাবে রাওয়ালপিন্ডির অস্ত্র কারখানা ও রেলওয়ে কর্মশালার শ্রমিকরাও ধর্মঘটে শামিল হয়, যার পরিণতিতে লালা লাজপত রায় ও অজিত সিং পাঞ্জাব থেকে বহিষ্কৃত হন।
  • বোম্বাইয়ের হরতাল (১৯০৮): লোকমান্য তিলকের কারাদণ্ডের প্রতিবাদে বোম্বাইয়ের শ্রমিক শ্রেণি ছয়দিন ধরে টানা হরতাল পালন করে এবং পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। লেনিন এই ঘটনাকে ভারতীয় শ্রমিক শ্রেণির রাজনৈতিক মঞ্চে আবির্ভাব বলে অভিহিত করেন। ঐতিহাসিক সুমিত সরকার এই ধর্মঘটকে ‘প্রকৃত অর্থে রাজনৈতিক ধর্মঘট’ বলে মন্তব্য করেন।

সুতরাং, বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলন শ্রমিক আন্দোলনকে অর্থনৈতিক দাবির গণ্ডি ছাড়িয়ে রাজনৈতিক ও জাতীয় স্তরে উন্নীত করে এবং সংগঠিত রূপ দেয়, যা ভারতের শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে এক নতুন যুগের সূচনা করে।

চ. বামপন্থী আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য কী ছিল? ভারতবর্ষে সমাজতন্ত্রের প্রসারের ক্ষেত্রে বামপন্থী গোষ্ঠীর ভূমিকা আলোচনা করো।

উত্তর: বামপন্থী আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য:
ভারতের রাজনীতিতে বামপন্থী আন্দোলনের উদ্ভব দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল বহুবিধ:

  • শোষিত শ্রেণির মুক্তি: জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির প্রভাবে নিপীড়িত, শোষিত কৃষক-শ্রমিক শ্রেণির মুক্তির প্রশ্নকে সামনে আনা এবং তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য সংগঠিত সংগ্রাম পরিচালনা করা।
  • সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা: ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের তীব্র বিরোধিতা করা এবং জাতীয় স্বাধীনতার দাবিকে জোরালোভাবে তুলে ধরা।
  • সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা: ভারতের মাটিতে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার বীজ বপন করা এবং একটি শোষণহীন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে একজন মানুষ অপরজনকে শোষণ করবে না। এর চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল সমাজতান্ত্রিক বা সাম্যবাদী বিপ্লব সম্পাদন করা।
  • জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে শ্রেণি সংগ্রামকে যুক্ত করা: জাতীয় সংগ্রামের ধারার সঙ্গে সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য শ্রমিক-কৃষকের সংগ্রামকে মেলানো এবং একটি ঐক্যবদ্ধ গণ-আন্দোলন গড়ে তোলা।
  • আপসহীন জাতীয় সংগ্রাম: ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে আপসহীন জাতীয় সংগ্রামের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা।

ভারতবর্ষে সমাজতন্ত্রের প্রসারের ক্ষেত্রে বামপন্থী গোষ্ঠীর ভূমিকা:
ভারতবর্ষে সমাজতন্ত্রের প্রসারের ক্ষেত্রে বামপন্থী গোষ্ঠী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল:

  • মতাদর্শ প্রচার: মানবেন্দ্রনাথ রায় বিদেশে ভারতের প্রথম কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন এবং তাঁর উদ্যোগে সমাজতন্ত্রের আদর্শ ভারতে প্রচারিত হয়। এস. এ. ডাঙ্গে, মুজফ্ফর আহমেদ, পি. সি. যোশী প্রমুখ নেতা এবং ‘দ্য সোশ্যালিস্ট’, ‘নবযুগ’, ‘লাঙল’, ‘ইনকিলাব’, ‘লেবার-কিষাণ গেজেট’ প্রভৃতি পত্রিকা ও পুস্তিকা সমাজতান্ত্রিক মত ও পথ প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।
  • সংগঠন গঠন: ১৯২৫ সালে কানপুরে ‘ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি’ গঠিত হয়। পরবর্তীকালে বিভিন্ন প্রদেশে ‘ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি’ এবং ১৯৩৪ সালে কংগ্রেসের অভ্যন্তরে ‘কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল’ গঠিত হয়। এছাড়া ১৯৩৯ সালে সুভাষচন্দ্র বসু ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ এবং বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দল (আর. এস. পি) গঠিত হয়। এই সংগঠনগুলি সমাজতন্ত্রের আদর্শ প্রচার ও প্রসারে সহায়তা করে।
  • গণসংগঠন: বামপন্থীদের উদ্যোগে নিখিল ভারত কৃষক সভা, নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস, নিখিল ভারত ছাত্র ফেডারেশন, নিখিল ভারত প্রগতি লেখক সংঘ প্রভৃতি গণসংগঠন গড়ে ওঠে, যেগুলি নিজ নিজ ক্ষেত্রে সমাজতান্ত্রিক আদর্শের ভিত্তিতে আন্দোলন পরিচালনা করে। স্বামী সহজানন্দ সরস্বতীর মতো নেতারা কৃষক সভাকে সংগ্রামী সংগঠনে পরিণত করেন।
  • যুবসমাজ ও বুদ্ধিজীবীদের আকর্ষণ: রুশ বিপ্লবের সাফল্য এবং দেশের অভ্যন্তরে অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহারজনিত হতাশা, অর্থনৈতিক মন্দা ও বেকার সমস্যা ভারতের যুবসম্প্রদায়, ছাত্র, বুদ্ধিজীবী ও বিপ্লবীদের সমাজতন্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট করে। জওহরলাল নেহরু ও সুভাষচন্দ্র বসুর মতো জাতীয় নেতারাও সমাজতন্ত্রের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তা প্রচারে সহায়তা করেন।
  • জাতীয় আন্দোলনে প্রভাব: বামপন্থীদের কার্যকলাপ জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যেও প্রভাব ফেলেছিল। নেহরু ও সুভাষচন্দ্রের মতো সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী নেতাদের কংগ্রেস সভাপতি পদে নির্বাচন এবং কংগ্রেসের মধ্যে বামপন্থী ঝোঁকের সৃষ্টি হয়। বামপন্থীরা জাতীয়তাবাদকে মৌলিক সামাজিক পরিবর্তনের দিকে ঠেলে দিয়েছিল।

এভাবে, বিভিন্ন সংগঠন, প্রচার, আন্দোলন এবং জাতীয় নেতাদের প্রভাবিত করার মাধ্যমে বামপন্থী গোষ্ঠী ভারতবর্ষে সমাজতন্ত্রের আদর্শকে জনগণের মধ্যে প্রসারিত করতে এবং জাতীয় আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে অনস্বীকার্য অবদান রেখেছিল।

অতিরিক্ত (Extras)

বহুনির্বাচনী প্রশ্ন (MCQs)

১. বিশ শতকে কৃষক আন্দোলনের নতুন বৈশিষ্ট্য কী ছিল?

ক. জাতীয় আন্দোলন
খ. স্বতন্ত্রতা
গ. জমিদারি সমর্থন
ঘ. শিল্প সমর্থন

উত্তর: ক. জাতীয় আন্দোলন

Missing answers are only available to registered users. Please register or login if already registered. How to register? Click on Menu and select Register

৫৫. ভারতীয় বামপন্থী গোষ্ঠী মূলত কোন আদর্শ প্রচার করেছিল?

ক. সমাজতন্ত্র
খ. ধর্মনিরপেক্ষতা
গ. পিতৃতন্ত্র
ঘ. জাতীয়তাবাদ

উত্তর: ক. সমাজতন্ত্র

প্রশ্ন ও উত্তর (Questions, Answers)

1. ভারতবর্ষে কৃষক আন্দোলন কোন শতক থেকে শুরু হয়েছিল?

উত্তর: উনিশ শতকে ভারতবর্ষের কৃষক সমাজ বার বার বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল।

Missing answers are only available to registered users. Please register or login if already registered. How to register? Click on Menu and select Register

40. বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলনের সম্পর্ক এবং তার প্রভাব বিশ্লেষণ করো।

উত্তর: বিশ শতকে ভারতের বামপন্থী রাজনীতি কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল এবং এই আন্দোলনগুলির উপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল।

সম্পর্ক:

১. সংগঠন: জাতীয় কংগ্রেস অনেক সময়েই কৃষকদের মূল দাবিদাওয়া পূরণে বা শ্রমিকদের সংগ্রামে সরাসরি অংশ নিতে দ্বিধা বোধ করত, পাছে জমিদার বা মালিক শ্রেণি বিরূপ হয়। এই শূন্যস্থানে বামপন্থী রাজনীতিবিদরা এগিয়ে আসেন। তাঁরা কৃষক ও শ্রমিকদের সংগঠিত করতে উদ্যোগী হন। বিহারে স্বামী সহজানন্দ সরস্বতী, অন্ধ্রপ্রদেশে এন. জি. রঙ্গা প্রমুখের নেতৃত্বে কৃষক সভা গড়ে ওঠে। ১৯৩৬ সালে মূলত বামপন্থী ও সমাজতন্ত্রী নেতাদের উদ্যোগে ‘সর্বভারতীয় কিষাণ সভা’ প্রতিষ্ঠিত হয়। একইভাবে শ্রমিকদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে বামপন্থীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিভিন্ন প্রাদেশিক সংগঠনকে একত্রিত করে ১৯২৮ সালে ‘ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস্ পার্টি’ গঠিত হয়, যা শ্রেণি সংগ্রাম ও শ্রমিক-কৃষকের দাবিদাওয়াকে সামনে আনে। বামপন্থীরা ‘নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস’ (AITUC)-এর মধ্যেও সক্রিয় ছিল।
২. আদর্শ: বামপন্থীরা কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলনকে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক দাবিপূরণের সংগ্রাম হিসেবে দেখেনি, বরং একে বৃহত্তর জাতীয় মুক্তি এবং সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সংগ্রামের অংশ হিসেবে বিবেচনা করত। তারা শ্রেণি সংগ্রাম, জমিদারি উচ্ছেদ, ন্যূনতম বেতন, সমাজতন্ত্র ইত্যাদি ধারণাগুলি এই আন্দোলনগুলির সঙ্গে যুক্ত করে।
৩. যৌথ কর্মসূচি: বামপন্থীরা প্রায়শই কংগ্রেসের অভ্যন্তরে থেকেও (যেমন কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল) বা বাইরে থেকেও কৃষক ও শ্রমিকদের দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন পরিচালনা করত এবং জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে এই শ্রেণি সংগ্রামকে যুক্ত করার চেষ্টা করত। সুভাষচন্দ্র বসুর ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ বা বিভিন্ন কমিউনিস্ট গোষ্ঠী এই প্রয়াসে সামিল ছিল।

প্রভাব:

১. আন্দোলনের চরিত্র বদল: বামপন্থীদের প্রভাবে কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলনগুলি শুধুমাত্র তাৎক্ষণিক দাবিদাওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে অনেক বেশি র‍্যাডিক্যাল বা চরমপন্থী চরিত্র ধারণ করে। কৃষি বিপ্লব বা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ধারণা আন্দোলনের লক্ষ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়। তেভাগা, তেলেঙ্গানা আন্দোলন এর উদাহরণ।
২. জাতীয় আন্দোলনে প্রভাব: বামপন্থীদের কার্যকলাপ জাতীয় কংগ্রেসের উপর চাপ সৃষ্টি করে। কৃষক ও শ্রমিকদের দুর্দশা এবং তাদের দাবিদাওয়াকে জাতীয় কংগ্রেস পুরোপুরি উপেক্ষা করতে পারেনি। জওহরলাল নেহরু, সুভাষচন্দ্র বসুর মতো নেতারা কংগ্রেসের অভ্যন্তরে বামপন্থী ভাবধারাকে শক্তিশালী করেন এবং পূর্ণ স্বাধীনতা ও আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের দাবিকে জোরালো করেন। বামপন্থীরা প্রমাণ করে যে ভারতের জনগণের দুর্দশার কারণ শুধু ঔপনিবেশিক শাসন নয়, দেশের অভ্যন্তরীণ সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও এর জন্য দায়ী।
৩. মতাদর্শগত প্রভাব: বামপন্থীরা ভারতে সাম্যবাদ ও সমাজতন্ত্রের আদর্শকে জনপ্রিয় করে তোলে। কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, যুব ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এই ধারণাগুলি প্রসারিত হয়।
৪. সংঘাত: বামপন্থীদের চরমপন্থী কর্মসূচি ও শ্রেণি সংগ্রামের ধারণা অনেক সময় জাতীয় কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থী নেতৃত্বের সঙ্গে তাদের সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য করে। কংগ্রেস কখনও কখনও বামপন্থী প্রভাবিত কৃষক বা শ্রমিক আন্দোলনকে সমর্থন জানায়নি বা দমন করারও চেষ্টা করেছে (যেমন ১৯৩৮-এর বোম্বাই শ্রমবিরোধ আইন)।

সামগ্রিকভাবে, বামপন্থী রাজনীতি ভারতের কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলনকে একটি নতুন দিশা ও শক্তি প্রদান করেছিল এবং জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের সঙ্গে সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির প্রশ্নকে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত করেছিল।

Get notes of other boards, classes, and subjects


Share with others

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Only registered users are allowed to copy.