এখানে (chapter 4) সংঘবদ্ধতার গোড়ার কথা: WBBSE ক্লাস 10 ইতিহাস (History) (Bengali medium) আধুনিক ভারতের ইতিহাস ও পরিবেশ (Adhunik Bharater Itihas O Poribesh)-এর উত্তর, ব্যাখ্যা, সমাধান, নোট, অতিরিক্ত তথ্য, এমসিকিউ এবং পিডিএফ পাওয়া যাবে। নোটগুলো শুধুমাত্র রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করুন এবং প্রয়োজনমতো পরিবর্তন করতে ভুলবেন না।
Select medium |
English medium notes |
Bengali medium notes |
সারাংশ (summary)
আমরা সংঘবদ্ধতার গোড়ার কথা (Sanghoboddhotar Gorar Kotha: Boishishto o Bishleshon) নিয়ে আলোচনা করব।
১৮৫৭ সালে ভারতে এক বিরাট বিদ্রোহ হয়েছিল। মীরাটের সিপাহীরা, মানে সৈন্যরা, ইংরেজ অফিসারদের কথা অমান্য করে দিল্লী চলে যায়। তারা মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহকে তাদের নেতা হতে অনুরোধ করে। এই বিদ্রোহের একটা বড় কারণ ছিল নতুন বন্দুকের টোটা, যাতে গরু আর শূকরের চর্বি মেশানো আছে বলে গুজব রটেছিল। এটা হিন্দু ও মুসলিম সিপাহীদের ধর্মের বিরুদ্ধে ছিল।
এই বিদ্রোহ শুধু সিপাহীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। নানা সাহেব, তাঁতিয়া টোপী, ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাঈ এবং সাধারণ মানুষও এতে যোগ দেন। তাই অনেকে একে শুধু সিপাহী বিদ্রোহ (Sepoy Mutiny) না বলে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ বা গণবিদ্রোহও বলেন। কিন্তু সবার মধ্যে যোগাযোগ ভালো ছিল না, আর ইংরেজদের অস্ত্রশস্ত্র অনেক ভালো ছিল। তাই এক বছর লড়াই চলার পর ইংরেজরা এই বিদ্রোহ দমন করে।
বিদ্রোহের পর ইংরেজ রানী ভিক্টোরিয়া সরাসরি ভারতের শাসনভার নিজের হাতে নেন। তিনি একটি ঘোষণাপত্র (Maharanir Ghoshanapatra) জারি করেন। এতে তিনি অনেক ভালো ভালো কথা বলেন, যেমন – ভারতীয়দের চাকরি দেওয়া হবে, তাদের ধর্ম ও রাজার সম্মান করা হবে। কিন্তু আসলে বেশিরভাগ কথাই রাখা হয়নি। তাই অনেকে এটাকে একটা ‘রাজনৈতিক ধাপ্পা’ (rajnoitik dhappa) বলেন, মানে এটা ছিল মানুষকে শান্ত করার একটা কৌশল মাত্র।
এই বিদ্রোহের পর ভারতীয়রা বুঝতে পারে যে একজোট হয়ে দাবি জানাতে হবে। তাই অনেক সভা-সমিতি তৈরি হতে শুরু করে। এই সময়টাকে ‘সভা-সমিতির যুগ’ (Sabhā-Samitir Yug) বলা হয়। জমিদার সভা (Zamindar Sabha), ভারত সভা (Bharat Sabha) এরকম অনেক সমিতি তৈরি হয়। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো নেতারা এই সব সমিতির মাধ্যমে মানুষকে এক করতেন ও সরকারের কাছে দাবি জানাতেন।
এই সময়ে লেখা ও আঁকার মাধ্যমেও মানুষের মনে দেশের প্রতি ভালোবাসা জাগানো হয়। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (Bankim Chandra Chattopadhyay) ‘আনন্দমঠ’ (Anandamath) নামে একটি বই লেখেন, যাতে ‘বন্দে মাতরম্’ গানটি ছিল। স্বামী বিবেকানন্দ (Swami Vivekananda) ‘বর্তমান ভারত’ (Bartaman Bharat) লিখে দেশের মানুষকে জেগে উঠতে বলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (Rabindranath Tagore) ‘গোরা’ (Gora) উপন্যাসে ভারতীয় একতা নিয়ে লেখেন। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর (Abanindranath Tagore) ‘ভারতমাতা’ (Bharat Mata) নামে একটি ছবি আঁকেন, যেখানে ভারতবর্ষকে একজন মায়ের মতো দেখানো হয়েছে। গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর (Gaganendranath Tagore) ব্যঙ্গচিত্র এঁকে ইংরেজ শাসন আর সমাজের নানা ভুল ধরিয়ে দিতেন। এইসব লেখা ও ছবি মানুষকে দেশের জন্য ভাবতে শিখিয়েছিল।
পাঠ্য প্রশ্ন ও উত্তর (Prantik textbook)
সঠিক উত্তরটি নির্বাচন করো
(ক) বিদ্রোহী সিপাহিদের নেতৃত্বদানকারী নানা সাহেবের সামরিক বাহিনীর নেতা ছিলেন-
(i) কুনওয়ার সিং
(ii) মঙ্গল পান্ডে
(iii) তাঁতিয়া টোপী
(iv) খান বাহাদুর খান
উত্তর: (iii) তাঁতিয়া টোপী
(খ) কার্ল মার্কস ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে বলেছেন-
(i) জাতীয় বিদ্রোহ
(ii) মহাবিদ্রোহ
(iii) সিপাহি বিদ্রোহ
(iv) গণবিদ্রোহ
উত্তর: (i) জাতীয় বিদ্রোহ
(গ) ‘বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা’র সম্পাদক ছিলেন-
(i) কালীনাথ রায়
(ii) গৌরীশঙ্কর তর্কবাগীশ
(iii) রাধাকান্ত দেব
(iv) প্রসন্নকুমার ঠাকুর
উত্তর: (ii) গৌরীশঙ্কর তর্কবাগীশ
(ঘ) ‘হিন্দুমেলা’র উদ্দেশ্য ছিল-
(i) ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন সংগঠিত করা
(ii) হিন্দুধর্মের সংস্কারসাধন
(iii) দেশজ শিল্পের প্রসার
(iv) জাতীয়তাবাদী ভাবধারার প্রসার।
উত্তর: (iv) জাতীয়তাবাদী ভাবধারার প্রসার।
(ঙ) ‘ভারতমাতা’ চিত্রটি আঁকেন-
(i) অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
(ii) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
(iii) নন্দলাল বসু
(iv) গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
উত্তর: (i) অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নীচের বিবৃতিগুলির মধ্যে কোনটি সত্য কোনটি মিথ্যা লেখো
(ক) ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার ১৮৫৭-র বিদ্রোহকে গণবিদ্রোহ বলে অভিহিত করেছেন।
উত্তর: মিথ্যা
কারণ: রমেশচন্দ্র মজুমদার ১৮৫৭-র বিদ্রোহকে সিপাহি বিদ্রোহ মাত্র বলেই মনে করতেন, গণবিদ্রোহ বা জাতীয় সংগ্রাম হিসাবে স্বীকৃতি দেননি।
(খ) মহারানির ঘোষণাপত্রের দ্বারা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হস্তে ভারতের শাসনভার তুলে দেওয়া হয়।
উত্তর: মিথ্যা
কারণ: ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইন ও মহারানির ঘোষণাপত্রের দ্বারা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অবলুপ্তি ঘটে এবং ভারতের শাসনভার সরাসরি ব্রিটেনের মহারানির হাতে তুলে দেওয়া হয়।
(গ) স্বাধীনতা আন্দোলনের যুগে ‘বন্দে মাতরম্’ মন্ত্র দেশবাসীকে উজ্জীবিত করে তুলেছিল।
উত্তর: ঠিক
কারণ: বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের ‘বন্দে মাতরম্’ সংগীতটি পরবর্তীকালে স্বদেশি যুগ থেকে শুরু করে জাতীয় গণ-আন্দোলনে দেশবাসীকে উজ্জীবিত করার মন্ত্রে পরিণত হয়েছিল।
(ঘ) অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর চিত্রশিল্পে বেঙ্গল স্কুল বা ওরিয়েন্টাল আর্টের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন।
উত্তর: ঠিক
কারণ: অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর চিত্রশিল্পে দেশীয় ঐতিহ্য অনুসরণ করে ‘বেঙ্গল স্কুল’ বা ‘ওরিয়েন্টাল আর্ট’ নামে নতুন ধারার সূচনা করেন, যা স্বদেশি ভাবধারার দ্বারা প্রভাবিত ছিল।
প্রদত্ত ভারতবর্ষের মানচিত্রে নিম্নলিখিত স্থানগুলি চিহ্নিত করো
(ক) লখনউ।
(খ) ১৮৫৭-র বিদ্রোহের কেন্দ্র।
(গ) উত্তর ভারতের সিপাহি বিদ্রোহের একটি কেন্দ্র।
বামস্তম্ভের সঙ্গে ডানস্তম্ভ মেলাও
বামস্তম্ভ | ডানস্তম্ভ |
(i) জর্জ টমসন | (a) ভারত সভা |
(ii) সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় | (b) আনন্দমঠ |
(iii) সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর | (c) বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া |
(iv) বঙ্গদর্শন | (d) হিন্দুমেল |
উত্তর:
বামস্তম্ভ | ডানস্তম্ভ |
(i) জর্জ টমসন | (c) বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া |
(ii) সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় | (a) ভারত সভা |
(iii) সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর | (d) হিন্দুমেলা |
(iv) বঙ্গদর্শন | (b) আনন্দমঠ |
একটি বাক্যেউত্তর দাও
ক. এনফিল্ড রাইফেলের টোটা কীভাবে ব্যবহার করতে হত?
উত্তর: এনফিল্ড রাইফেলের নতুন টোটাগুলিতে গোরু ও শূকরের চর্বি মেশানো আছে বলে কথা শোনা যাওয়ায়, এবং দাঁতে কেটে এই টোটা ব্যবহার করতে হত বলে সিপাহিরা মনে করেন যে কোম্পানি তাঁদের ধর্ম ও জাতি নাশ করার চেষ্টা করছে।
খ. ১৮৫৭-র বিদ্রোহ সম্পর্কে জে. বি. নর্টন কী মন্তব্য করেছিলেন?
উত্তর: জে. বি. নর্টন মন্তব্য করেছিলেন যে, ১৮৫৭-র বিদ্রোহ সামান্য সিপাহি বিদ্রোহ ছিল না, এই অভ্যুত্থান গণবিদ্রোহের রূপ ধারণ করেছিল এবং অযোধ্যায় সারা দেশবাসীর সশস্ত্র অভ্যুত্থান দেখা গিয়েছিল যেখানে বর্শা, ধনুক ও দেশি বন্দুকধারী অগণিত লোকের সঙ্গে লড়াই হয়েছিল।
গ. ‘ব্রিটিশ ভারত সভা’ কোন্ দুটি সংস্থাকে যুক্ত করে তৈরি হয়?
উত্তর: ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে ‘জমিদার সভা’ ও ‘বেঙ্গল ব্রিটিশ-ইন্ডিয়া সোসাইটি’, এই দুটি সংস্থাকে যুক্ত করে ‘ব্রিটিশ ভারত সভা’ বা ‘British-Indian Association’ নামে একটি রাজনৈতিক সংগঠন তৈরি হয়।
ঘ. ভারত সভার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা দুটি আন্দোলনের উল্লেখ করো।
উত্তর: ভারত সভার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা দুটি আন্দোলন হল ভারতীয় সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা সংক্রান্ত আন্দোলন এবং ইলবার্ট বিল আন্দোলন।
ঙ. ‘আনন্দমঠ’-এর কাহিনিতে কোন্ সময়ের কথা লেখক তুলে ধরেছেন?
উত্তর: ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে লেখক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আঠারো শতকের শেষ দিকে বাংলার এক সংকটজনক সময়ের ছবি তুলে ধরেছেন, যা মোগল যুগের সমাপ্তি এবং ইংরেজ আমলের গোড়ার দিক পর্যন্ত বিস্তৃত।
চ. বিবেকানন্দের ‘বর্তমান ভারত’ প্রবন্ধটি’ কবে, কোথায় প্রকাশিত হয়েছিল?
উত্তর: বিবেকানন্দের ‘বর্তমান ভারত’ প্রবন্ধটি ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে উদ্বোধন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
সংক্ষিপ্ত উত্তরধর্মী প্রশ্ন
ক. সিপাহি বিদ্রোহের সঙ্গে ১৮৫৭-র পূর্বের সংগঠিত ইংরেজ-বিরোধী প্রতিরোধ ও অভ্যুত্থানগুলির কী কোনো চরিত্রগত পার্থক্য ছিল?
উত্তর: ১৮৫৭ সালের আগের প্রতিরোধ ও অভ্যুত্থানগুলি ছিল অসংগঠিত এবং সেগুলি কখনই আঞ্চলিকতার সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে পারেনি। কিন্তু ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহে এই প্রথমবার আঞ্চলিক গণ্ডির সীমারেখা ভেঙে গিয়েছিল এবং এমন বিশাল গণ-অভ্যুত্থান ভারতের গণবিদ্রোহের ইতিহাসে কোম্পানি-রাজের বিরুদ্ধে আগে কখনও হয়নি।
খ. সিপাহিরা তাদের বিদ্রোহকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল?
উত্তর: বিদ্রোহের আগে পরিকল্পনা ও সংগঠনের অভাব থাকলেও বিদ্রোহ শুরুর পর তা নিশ্চিতভাবেই গড়ে উঠেছিল। দিল্লি দখলের পরেই সব প্রতিবেশী রাজ্যের শাসকদের কাছে বিদ্রোহে সমর্থন চেয়ে ও যোগদানের আহ্বান জানিয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছিল। দিল্লিতে প্রশাসকদের একটি দরবার স্থাপন করা হয়েছিল, যার দায়িত্ব ছিল রাষ্ট্রশাসন সংক্রান্ত সমস্ত ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া। অন্যান্য জায়গাতেও সংগঠন গড়ে তোলার প্রয়াস চালানো হয়েছিল।
গ. সভা-সমিতির যুগ কাকে বলে?
উত্তর: উনিশ শতকে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে জাতীয়তাবাদী ভাবধারা এবং রাজনৈতিক চেতনার প্রকাশ হতে থাকে। ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করে তাঁরা বিভিন্ন সামাজিক, প্রশাসনিক সংস্কারসাধনে ও ভারতবাসীর অধিকার রক্ষার জন্য নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক সংস্থা গঠনের সূচনা করেন। এই সময় অনেকগুলি সভা-সমিতি গড়ে ওঠে, যা জাতীয়তাবাদী ভাবধারা এবং রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যম হয়ে ওঠে। এই কারণে ঐতিহাসিক ড. অনিল শীল উনিশ শতককে ‘The Age of Associations’ বা ‘সভা-সমিতির যুগ’ বলে চিহ্নিত করেছেন।
ঘ. ভারতের প্রথম সর্বভারতীয় রাজনৈতিক সংগঠন কোন্টি? এই সংগঠনের উদ্দেশ্য কী ছিল?
উত্তর: ভারতের প্রথম সর্বভারতীয় রাজনৈতিক সংগঠন ছিল ‘ব্রিটিশ ভারত সভা’ বা ‘British-Indian Association’, যা ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে ‘জমিদার সভা’ ও ‘বেঙ্গল ব্রিটিশ-ইন্ডিয়া সোসাইটি’ যুক্ত করে তৈরি হয়। এই সংগঠনের উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয়দের অবস্থার উন্নতিসাধন করা এবং আইন ও প্রশাসন ব্যবস্থাকে ত্রুটিমুক্ত করা।
ঙ. ‘হিন্দুমেলা’ গড়ে ওঠার পিছনে কী কারণ ছিল বলে তোমার মনে হয়?
উত্তর: উনিশ শতকে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার একদিকে জাতীয়তাবাদী ভাবধারা বিকাশে সহায়ক হলেও, অন্যদিকে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণ যুবসমাজকে নিজের ঐতিহ্য থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। এই অবস্থায় রাজনারায়ণ বসু, নবগোপাল মিত্র, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ বাঙালি মনীষীরা দেশের যুবসমাজকে ঐতিহ্যমুখী করে তুলে জাতীয়তাবাদী ভাবধারা প্রসারের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন, আর এই উদ্দেশ্যেই হিন্দুমেলার জন্ম হয়।
চ. গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যঙ্গচিত্রের বিষয় কী ছিল?
উত্তর: গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যঙ্গচিত্রের বিষয় ছিল সমকালীন সমাজ ও সময়ের নানান অসংগতি। তাঁর ব্যঙ্গচিত্রগুলিতে ঔপনিবেশিক সমাজের সমালোচনা ফুটে উঠত, যেখানে বিদেশি শাসকদের পাশাপাশি দেশীয় নেতারা, এমনকি রবীন্দ্রনাথও ব্যঙ্গের আওতায় পড়তেন। ঔপনিবেশিক শাসকদের কাছে মাথা নোয়ানো মানুষ, শহুরে জীবনের কৃত্রিম সাহেবিয়ানা, বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর আবিষ্কার, প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের গবেষণা, রবীন্দ্রনাথের প্রথম বিমান চড়া, রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথের মন্ত্রিত্ব গ্রহণ ইত্যাদি নানা বিষয় তাঁর শ্লেষাত্মক কার্টুন চিত্রের বিষয়বস্তু ছিল।
বিশ্লেষণধর্মী প্রশ্ন
ক. ১৮৫৭-র বিদ্রোহে কারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন? এই নেতৃত্বে কী কোনো সমস্যা ছিল বলে তোমার মনে হয়?
উত্তর: বাহাদুর শাহকে ভারত সম্রাট করার কথা ঘোষণা হলে ভারতের নানা প্রান্তে অভূতপূর্ব উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। দ্বিতীয় বাজীরাওয়ের দত্তক পুত্র নানা সাহেবের সামরিক বাহিনী কানপুরের সিপাহি বিদ্রোহে যোগ দেয়। নানা সাহেবের সামরিক বাহিনীর নেতা তাঁতিয়া টোপী বিদ্রোহী সিপাহিদের নেতৃত্বদান করেন। একে একে ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈ, অযোধ্যার বেগম, খান বাহাদুর খান, কুনওয়ার সিং প্রমুখ বিদ্রোহে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে শুরু করেন।
বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেকেই বিদেশি শাসনকে ঘৃণা করত। এইটুকু ছাড়া সামগ্রিক রাজনীতি বা দূরবর্তী ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তাঁদের স্পষ্ট ধারণা ছিল না। এঁদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন ‘নিজেদের অতীতের হাতে বন্দী।’ নতুন কোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থার আগমনের কথা তাঁদের জানানোর ক্ষমতা ছিল না। জন লরেন্স ঠিকই বলেছেন, “তাদের (বিদ্রোহীদের) মধ্য থেকে যদি একজনও যোগ্য নেতার আবির্ভাব ঘটত তাহলে আমরা এমন গো-হারা হারতাম যে সেই ক্ষতি আর পূরণ করা যেত না।”
খ. ১৮৫৭-র বিদ্রোহ কী শুধুমাত্র সিপাহিদের বিদ্রোহ ছিল, নাকি একে গণবিদ্রোহও বলা যেতে পারে?
উত্তর: অনেক ইউরোপীয় ঐতিহাসিক এই বিদ্রোহকে সিপাহি বিদ্রোহ (Sepoy Mutiny) বলে অভিহিত করেছেন। তবে অনেকের কাছেই এই মত যুক্তিগ্রাহ্য নয়। ব্যারাকপুরের ব্রাহ্মণ সিপাহি মঙ্গল পান্ডের ফাঁসির প্রতিবাদে যে বিদ্রোহের সূচনা, বাহাদুর শাহকে ভারতের সম্রাট হিসাবে ঘোষণা করে যে বিদ্রোহের প্রসার তা ক্রমে সংক্রমিত হয় দেশের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে। ডক্টর এ. আর. দেশাইয়ের মতে “১৮৫৭-র বিদ্রোহ ছিল ব্রিটিশ শাসনে নির্যাতিত বিভিন্ন শ্রেণীর ভারতবাসীর সম্মিলিত অসন্তোষের ফল। এই অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছিল রাজনৈতিক বিস্তৃতি, অর্থনৈতিক শোষণ এবং নানা সামাজিক উদ্ভাবন থেকে।”
১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে চার্লস রেইকস্ তাঁর ‘Notes on the Revolt in North Western Provience of India’-তে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে সংগঠিত বিদ্রোহকে সিপাহি বিদ্রোহ বলে অভিহিত করেন। ব্রিটিশ ঐতিহাসিক জন লরেন্স, আর্ল রবার্টস প্রমুখরা রেইকস্-এর বক্তব্যে সহমত পোষণ করেন। উনিশ শতকের শেষে বাঙালি তথা ভারতীয় বুদ্ধিজীবীরা যেমন কিশোরীচাঁদ মিত্র, রাজনারায়ণ বসু, হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, দাদাভাই নৌরজি, সৈয়দ আহমেদ খান প্রমুখরাও এই বিদ্রোহকে সিপাহিদের অভ্যুত্থান হিসাবেই ব্যাখ্যা করেছেন। কিশোরীচাঁদ মিত্রের মতে- “এই বিদ্রোহ ছিল অবশ্যই কেবলমাত্র সিপাহিদের অভ্যুত্থান। এক লক্ষ সিপাহি এই বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিলেন। এই অভ্যুত্থানে গণবিদ্রোহের ছিটেফোঁটাও ছিল না।” আধুনিক জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকদের মধ্যে রমেশচন্দ্র মজুমদার অত্যন্ত জোর দিয়ে বলেছেন যে, এই বিদ্রোহ সিপাহি বিদ্রোহ মাত্র। সিপাহিরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করার জন্যই এই বিদ্রোহ করেছিল। ভারতীয় জনসাধারণের এক বিরাট অংশ এই বিদ্রোহে যোগদান করেনি। অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ সেনের কণ্ঠেও রমেশচন্দ্রের বক্তব্যই ধ্বনিত হয়েছে।
অন্যদিকে জে. বি. নর্টন তাঁর ‘Topics for Indian Statesman’-এ প্রথম উল্লেখ করেন যে, ১৮৫৭-র বিদ্রোহ সামান্য সিপাহি বিদ্রোহ ছিল না, এই অভ্যুত্থান গণবিদ্রোহের রূপ ধারণ করেছিল। নর্টন লিখেছিলেন-‘অযোধ্যায় সারা দেশবাসীর সশস্ত্র অভ্যুত্থান দেখা গেল। বর্শা, ধনুক ও দেশি বন্দুকধারী অগণিত লোকের সঙ্গে লড়াই হল।’ ডাফ, কায়ে, বল, ম্যালেসন প্রমুখ ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নর্টনের বক্তব্যকে সমর্থন জানিয়েছেন। কার্ল মার্কস এই বিদ্রোহের মধ্যে ভারতের শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের ঐক্যের প্রকাশ লক্ষ করেছিলেন। পরবর্তীকালে ঐতিহাসিক ড. শশীভূষণ চৌধুরী, ড. তারাচাঁদ প্রমুখ এই বিদ্রোহের মধ্যে গণ-উপাদান ও জাতীয় আবেগ-উদ্দীপনা লক্ষ করেছেন। ভারতের উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ, মধ্য ভারতের বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে যে অভ্যুত্থান ঘটে তাকে গণবিক্ষোভ বলা যেতেই পারে। কার্ল মার্কস এই বিদ্রোহ প্রসঙ্গে বলেছিলেন-ব্রিটিশ শাসক যেটাকে সামরিক বিদ্রোহ বলে ভাবছে সেটা আসলে একটা জাতীয় বিদ্রোহ। New York Daily Tribune পত্রিকায় তিনি একে ‘ভারতের প্রথম ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’ বলে অভিহিত করেছেন। তার মতে, বিদ্রোহী সিপাহিরা ছিল জাতীয় বিদ্রোহের ‘ক্রিয়াশীল হাতিয়ার মাত্র’।
গ. মহারানির ঘোষণাপত্রে কী কী বলা হয়েছিল?
উত্তর: ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ১ নভেম্বরে এলাহাবাদে এক দরবারে আনুষ্ঠানিক ভাবে মহারানির ঘোষণা প্রকাশ করা হয়। এই ঘোষণাপত্রে ভারতবাসীর আনুগত্যলাভের উদ্দেশ্যে কয়েকটি আশ্বাসবাণী উচ্চারিত হয়, যেমন- স্বত্ববিলোপ নীতি বাতিল করা হবে। ব্রিটিশ সরকার রাজ্যবিস্তার নীতি বর্জন করবে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত যোগ্যতাসম্পন্ন ভারতীয়দের সরকারি পদে নিযুক্ত করা হবে। দেশীয় রাজ্যগুলির সঙ্গে ইতিপূর্বে সম্পাদিত চুক্তিগুলি বহাল থাকবে। দেশীয় রাজন্যবর্গ দত্তক গ্রহণ করতে পারবে। ভারতের চিরায়ত রীতি-নীতি, ধর্ম ও সামাজিক বিষয়ে সরকার অহেতুক হস্তক্ষেপ করবে না। বিদ্রোহে প্রত্যক্ষ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি ছাড়া সবাইকে মুক্তি দেওয়া হবে। বাজেয়াপ্ত সম্পত্তিও ফিরিয়ে দেওয়া হবে।
ঘ. ‘ভারতমাতা’ চিত্রটির মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবোধ কীভাবে ফুটে উঠেছে?
উত্তর: এই সময় অবনীন্দ্রনাথের আঁকা ‘ভারতমাতা’ চিত্রটি মানুষের মধ্যে উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। এই ছবিটির মধ্য দিয়ে অবনীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবোধ ফুটে উঠেছে। শিল্পীর ভাবনায়, ভারতমাতা গেরুয়া বসন পরিহিতা যোগিনী মূর্তি। তিনি বরাভয়দায়িনী। ত্যাগ ও বৈরাগ্যের মূর্ত প্রতীক। ভারতমাতার চার হাতে শোভা পায় রুদ্রাক্ষের মালা, শুভ্রবস্ত্র, পুঁথি ও শ্যামল শস্যগুচ্ছ। ভারতমাতা চিত্রটির মধ্য দিয়ে শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ধনধান্যপূর্ণ সমৃদ্ধশালী ভারতের ছবি আমাদের সামনে তুলে ধরতে চেয়েছেন। এই ভারতবর্ষ শিক্ষা-সংস্কৃতিতে উন্নত ভারতবর্ষ। ত্যাগ ও শান্তির আদর্শে মহিমান্বিত ভারতবর্ষ। ভারতমাতা চিত্রটি স্বদেশি যুগে বিভিন্ন সভা, সমাবেশে সজ্জিত হত। ভগিনী নিবেদিতা মডার্ন রিভিউ পত্রিকায় ছবিটির কল্পনা ও অনুভবের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন।
ঙ. ‘বর্তমান ভারত’ গ্রন্থটি দেশপ্রেমিকদের জাতীয়তাবোধে অনুপ্রাণিত করে-এই মন্তব্যটির যথার্থতা বিচার করো।
উত্তর: ‘বর্তমান ভারত’ প্রবন্ধে স্বামীজির স্বদেশের প্রতি আবেগ ফুটে উঠেছে। ‘স্বদেশ মন্ত্র’ শীর্ষক অনুচ্ছেদটিতে আত্মবিশ্বাসহীন, দুর্বল ভারতবর্ষের প্রতি স্বামীজি ধিক্কার জানিয়েছেন-“হে ভারত, এই পরানুবাদ, পরানুকরণ পরমুখাপেক্ষা, এই দাসসুলভ দুর্বলতা, এই ঘৃণিত জঘন্য নিষ্ঠুরতা-এই মাত্র সম্বলে তুমি উচ্চাধিকার লাভ করিবে?” তিনি ভারতবাসীকে জড়তা, অলসতা, হীনমন্যতা ত্যাগ করে আত্মশক্তিতে জেগে ওঠার ডাক দেন। দেশবাসীকে স্বদেশচেতনায় উদ্বুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে ঘোষণা করেন-“ভুলিও না, তুমি জন্ম হইতেই মায়ের জন্য বলিপ্রদত্ত।” বিবেকানন্দ বিশ্বাস করতেন জাতিভেদ, অস্পৃশ্যতা জাতির প্রাণশক্তিকে ক্ষয় করে। তিনি ভারতবাসীকে সংকীর্ণ জাতপাতের গণ্ডি অতিক্রম করে এক হওয়ার আহ্বান জানান- “ভুলিও না নীচ জাতি, মূর্খ, দরিদ্র, অজ্ঞ, মুচি, মেথর তোমার রক্ত, তোমার ভাই।” মানবজাতির অগ্রগতির ইতিহাস পর্যালোচনা করে বিবেকানন্দ উপলব্ধি করেছিলেন যে, এক সময় শূদ্রের উত্থান ঘটবেই। তিনি এই প্রবন্ধে বলেছেন, শূদ্রের উত্থান হলে এক নতুন সমাজব্যবস্থা স্থাপিত হবে। সেই সমাজ হবে সাম্য ও ন্যায়ের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা এক নতুন সমাজ। এক্ষেত্রে তাঁর জাতীয়তাবাদী ভাবনার সঙ্গে সমাজবাদ এক হয়ে গেছে। বিবেকানন্দের স্বদেশমন্ত্র ছিল দেশের প্রতি তীব্র ভালোবাসা, আবেগ। তিনি এই প্রবন্ধে লেখেন- “ভারতবাসী আমার প্রাণ, ভারতের দেবদেবী আমার ঈশ্বর, ভারতের সমাজ আমার শিশুশয্যা, আমার যৌবনের উপবন, আমার বার্ধক্যের বারাণসী।” দেশের সঙ্গে এই একাত্মবোধকেই তিনি ভারতবাসীর মধ্যে জাগ্রত করতে চেয়েছিলেন। বর্তমান ভারত গ্রন্থ দেশপ্রেমিকদের জাতীয়তাবোধে অনুপ্রাণিত করে। তাঁর লেখা প্রতিটি কথা ছিল প্রেরণার মতো। ধর্মের সঙ্গে মানুষ, সমাজ ও দেশকে একসূত্রে গেঁথে তিনি যে কর্মসাধনার নির্দেশ দেন তাই আধুনিক ভারত নির্মাণের মূল সূত্র হয়ে ওঠে। ‘বর্তমান ভারত’ সেই আধুনিক ভারত নির্মাণের দিককেই নির্দেশ করে। বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষের মতে, “বিবেকানন্দই আমাদের জাতীয় জীবন গঠনকর্তা।” ঐতিহাসিক আর. জি. প্রধান তাঁকে ‘ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জনক’ বলে অভিহিত করেন।
ব্যাখ্যাধর্মী প্রশ্ন
ক. ১৮৫৭-র বিদ্রোহের চরিত্র সম্পর্কে আলোচনা করো।
উত্তর: ১৮৫৭-র বিদ্রোহের চরিত্র ও প্রকৃতি নিয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে। অনেক ইউরোপীয় ঐতিহাসিক এই বিদ্রোহকে সিপাহি বিদ্রোহ (Sepoy Mutiny) বলে অভিহিত করেছেন, তবে অনেকের কাছেই এই মত যুক্তিগ্রাহ্য নয়। ব্যারাকপুরের ব্রাহ্মণ সিপাহি মঙ্গল পান্ডের ফাঁসির প্রতিবাদে যে বিদ্রোহের সূচনা, বাহাদুর শাহকে ভারতের সম্রাট হিসাবে ঘোষণা করে যে বিদ্রোহের প্রসার তা ক্রমে সংক্রমিত হয় দেশের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে। ডক্টর এ. আর. দেশাইয়ের মতে “১৮৫৭-র বিদ্রোহ ছিল ব্রিটিশ শাসনে নির্যাতিত বিভিন্ন শ্রেণীর ভারতবাসীর সম্মিলিত অসন্তোষের ফল। এই অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছিল রাজনৈতিক বিস্তৃতি, অর্থনৈতিক শোষণ এবং নানা সামাজিক উদ্ভাবন থেকে।”
সিপাহিরা ছিলেন ভারতে ব্রিটিশ শাসনের প্রহরী এবং তাদের সাহায্যেই ইংরেজরা ভারতে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। কিন্তু তারা নানাভাবে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হতেন, যেমন স্বল্প বেতন, ইউরোপীয় কর্মচারীর দুর্ব্যবহার, পদোন্নতির সুযোগের অভাব এবং বৈষম্যমূলক আচরণ। এনফিল্ড রাইফেলের নতুন টোটায় গোরু ও শূকরের চর্বি মেশানো আছে এবং তা দাঁতে কেটে ব্যবহার করতে হবে শুনে সিপাহিরা মনে করেন যে কোম্পানি তাঁদের ধর্ম ও জাতি নাশ করার চেষ্টা করছে, যা অসন্তোষের বারুদে অগ্নিসংযোগ করে।
বিদ্রোহের আগে পরিকল্পনা ও সংগঠনের অভাব থাকলেও বিদ্রোহ শুরুর পর তা নিশ্চিতভাবেই গড়ে উঠেছিল। দিল্লি দখলের পরেই সব প্রতিবেশী রাজ্যের শাসকদের কাছে বিদ্রোহে সমর্থন চেয়ে ও যোগদানের আহ্বান জানিয়ে চিঠি পাঠানো হয়। দিল্লিতে প্রশাসকদের একটি দরবার স্থাপন করা হয় এবং এই দরবারের দায়িত্ব ছিল রাষ্ট্রশাসন সংক্রান্ত সমস্ত ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া। অন্যান্য জায়গাতেও সংগঠন গড়ে তোলার প্রয়াস চালানো হয়।
বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেকেই বিদেশি শাসনকে ঘৃণা করত, কিন্তু সামগ্রিক রাজনীতি বা দূরবর্তী ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তাঁদের স্পষ্ট ধারণা ছিল না। জন লরেন্সের মতে, তাদের মধ্যে একজনও যোগ্য নেতার আবির্ভাব ঘটলে ব্রিটিশদের পরাজয় নিশ্চিত ছিল।
১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে চার্লস রেইকস্ তাঁর ‘Notes on the Revolt in North Western Provience of India’-তে এই বিদ্রোহকে সিপাহি বিদ্রোহ বলে অভিহিত করেন। ব্রিটিশ ঐতিহাসিক জন লরেন্স, আর্ল রবার্টস প্রমুখরা তাঁর বক্তব্যে সহমত পোষণ করেন। উনিশ শতকের বাঙালি তথা ভারতীয় বুদ্ধিজীবীরা যেমন কিশোরীচাঁদ মিত্র, রাজনারায়ণ বসু, হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, দাদাভাই নৌরজি, সৈয়দ আহমেদ খান প্রমুখরাও এই বিদ্রোহকে সিপাহিদের অভ্যুত্থান হিসাবেই ব্যাখ্যা করেছেন। কিশোরীচাঁদ মিত্রের মতে, এই বিদ্রোহ ছিল অবশ্যই কেবলমাত্র সিপাহিদের অভ্যুত্থান এবং এতে গণবিদ্রোহের ছিটেফোঁটাও ছিল না। আধুনিক জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকদের মধ্যে রমেশচন্দ্র মজুমদার জোর দিয়ে বলেছেন যে, এই বিদ্রোহ সিপাহি বিদ্রোহ মাত্র এবং সিপাহিরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করার জন্যই এই বিদ্রোহ করেছিল, যাতে ভারতীয় জনসাধারণের এক বিরাট অংশ যোগদান করেনি। অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ সেনও মনে করেন, সিপাহিদের অভ্যুত্থানের সুযোগে একদল হতাশ সামন্তপ্রভু ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করতে অংশ নিয়েছিল এবং বিদ্রোহগুলি বিক্ষিপ্ত ছিল। এঁদের মতে, বিদ্রোহের প্রভাব অযোধ্যা ও উত্তরপ্রদেশের কয়েকটি অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে বিদ্রোহীদের নিবিড় সম্পর্ক তৈরি হতে পারেনি। দাদাভাই নৌরজি মন্তব্য করেছিলেন যে ভারতীয় জনসাধারণ শুধু বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেনি তা নয়, উপরন্তু ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের আহ্বানে সাড়া দিয়েছিল এবং তাদের সমর্থন করেছিল।
অন্যদিকে জে. বি. নর্টন তাঁর ‘Topics for Indian Statesman’-এ প্রথম উল্লেখ করেন যে, ১৮৫৭-র বিদ্রোহ সামান্য সিপাহি বিদ্রোহ ছিল না, এই অভ্যুত্থান গণবিদ্রোহের রূপ ধারণ করেছিল। তিনি লিখেছিলেন অযোধ্যায় সারা দেশবাসীর সশস্ত্র অভ্যুত্থান দেখা গেল। ডাফ, কায়ে, বল, ম্যালেসন প্রমুখ ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নর্টনের বক্তব্যকে সমর্থন জানিয়েছেন। কার্ল মার্কস এই বিদ্রোহের মধ্যে ভারতের শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের ঐক্যের প্রকাশ লক্ষ করেছিলেন। পরবর্তীকালে ঐতিহাসিক ড. শশীভূষণ চৌধুরী, ড. তারাচাঁদ প্রমুখ এই বিদ্রোহের মধ্যে গণ-উপাদান ও জাতীয় আবেগ-উদ্দীপনা লক্ষ করেছেন। বিদ্রোহ দমন করতে ইংরেজদের এক বছর ধরে সামরিক অভিযান পরিচালনা করতে হয়েছিল, যা বিদ্রোহের জনসমর্থন প্রমাণিত করে। ভারতের উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ, মধ্য ভারতের বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে যে অভ্যুত্থান ঘটে তাকে গণবিক্ষোভ বলা যেতেই পারে। কার্ল মার্কস এই বিদ্রোহ প্রসঙ্গে বলেছিলেন-ব্রিটিশ শাসক যেটাকে সামরিক বিদ্রোহ বলে ভাবছে সেটা আসলে একটা জাতীয় বিদ্রোহ। New York Daily Tribune পত্রিকায় তিনি একে ‘ভারতের প্রথম ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’ বলে অভিহিত করেছেন। তার মতে, বিদ্রোহী সিপাহিরা ছিল জাতীয় বিদ্রোহের ‘ক্রিয়াশীল হাতিয়ার মাত্র’।
খ. ১৮৫৭-র বিদ্রোহকে কি জাতীয় সংগ্রাম বলা যায়? তোমার উত্তরের সপক্ষে যুক্তি দাও।
উত্তর: ১৮৫৭-র বিদ্রোহকে জাতীয় সংগ্রাম বলা যায় কিনা তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে।
জাতীয় সংগ্রাম বলার সপক্ষে যুক্তি: জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকদের অনেকেই মহাবিদ্রোহকে জাতীয় সংগ্রাম হিসাবে ব্যাখ্যা করেছেন। রজনীকান্ত গুপ্ত তাঁর ‘সিপাহি যুদ্ধের ইতিহাস’ গ্রন্থে বলেছেন যে, সিপাহিরা জাতীয়তাবাদী আদর্শে উজ্জীবিত হয়েই ইংরেজ শাসনের অবসান চেয়েছিল। বীর সাভারকরও এই বিদ্রোহকে ‘ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম’ বলে অভিহিত করেছেন। ঐতিহাসিক শশীভূষণ চৌধুরী একে একইসঙ্গে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয় যুদ্ধ ও গণবিদ্রোহ বলে ব্যাখ্যা করেছেন। ড. শশীভূষণ চৌধুরী, ড. তারাচাঁদ প্রমুখ এই বিদ্রোহের মধ্যে গণ-উপাদান ও জাতীয় আবেগ-উদ্দীপনা লক্ষ করেছেন। সুশোভন সরকার সিপাহি বিদ্রোহকে জাতীয় সংগ্রাম আখ্যায় ভূষিত করেছেন। তাঁর মতে, বিশ্বের কোনো দেশের জাতীয় সংগ্রামেই শতকরা একশো ভাগ মানুষ অংশগ্রহণ করেনি, তবুও সেগুলি ইতিহাসের পাতায় মুক্তি সংগ্রাম ও স্বাধীনতার যুদ্ধ হিসাবেই স্বীকৃতি পেয়েছে। কার্ল মার্কস এই বিদ্রোহ প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে ব্রিটিশ শাসক যেটাকে সামরিক বিদ্রোহ বলে ভাবছে সেটা আসলে একটা জাতীয় বিদ্রোহ এবং New York Daily Tribune পত্রিকায় তিনি একে ‘ভারতের প্রথম ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’ বলে অভিহিত করেছেন।
জাতীয় সংগ্রাম না বলার সপক্ষে যুক্তি: ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার এই অভ্যুত্থানকে জাতীয় যুদ্ধ বা স্বাধীনতা সংগ্রাম হিসাবে স্বীকৃতি দেননি। তাঁর মতে, যে সময় এই বিদ্রোহ সংগঠিত হয় ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা তখনও বিকাশ লাভ করেনি। তাছাড়া ভারতের সর্বত্র এই বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়েনি এবং দেশের সব প্রান্তের জনসাধারণের সঙ্গে বিদ্রোহের কোনো যোগাযোগই তৈরি হয়নি। অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ সেনও এই বিদ্রোহকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম বলতে নারাজ। তাঁর মতে, এই বিদ্রোহের ভারতীয় সিপাহিরা তেমন কোনো দেশপ্রেম, জাতীয় স্তরে পরিকল্পনা, সংগঠন, শৃঙ্খলাবোধ দেখাতে পারেনি। তাঁর মতে, সিপাহিদের অভ্যুত্থানের সুযোগে একদল হতাশ সামন্তপ্রভু ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করতে এই বিদ্রোহের অংশ হয়ে উঠেছিল এবং বিদ্রোহগুলি বিক্ষিপ্ত ছিল। দাদাভাই নৌরজি মন্তব্য করেছিলেন যে ভারতীয় জনসাধারণ এই বিদ্রোহে শুধু অংশগ্রহণ করেনি তা নয়, উপরন্তু ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের আহ্বানে সাড়া দিয়েছিল এবং তাদের সমর্থন করেছিল।
গ. ভারত সভার মূল উদ্দেশ্যগুলি কী ছিল? ভারত সভার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনগুলির পরিচয় দাও।
উত্তর: ভারত সভার মূল উদ্দেশ্যগুলি ছিল:
- দেশে এক শক্তিশালী জনমত গড়ে তোলা।
- ভারতের রাজনৈতিক স্বার্থকে কেন্দ্র করে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে ভারতবাসীদের সংঘবদ্ধ করা।
- হিন্দু ও মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ করে রাজনৈতিক আন্দোলনে তাদের শামিল করা।
সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ভারত সভার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘ভারত সভা’ যথার্থ প্রয়োজন মেটায়, মধ্যবিত্ত শ্রেণির গণ-চেতনা প্রতিফলিত করে এবং বাংলার শিক্ষিত সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বের কেন্দ্র হয়ে ওঠে।
ভারত সভার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক আন্দোলনগুলি: ভারত সভার উদ্যোগে সাধারণ রায়ত এবং চা বাগানের কুলি ইত্যাদি নিম্নবর্ণের মানুষদের কল্যাণে নানান কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। এছাড়া পাবনার কৃষক বিদ্রোহের সমর্থনে এবং ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দের ‘রেন্ট আইন’-এর বিরুদ্ধে ভারত সভা আন্দোলন গড়ে তোলে।
- ভারতীয় সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা আন্দোলন: সুরেন্দ্রনাথের নেতৃত্বে এই আন্দোলন ছিল ভারত সভার এক উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক পদক্ষেপ। সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার নিয়মকানুন ও পরীক্ষার্থীদের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ইউরোপীয়দের সুবিধার্থে নির্ধারণ করা হয়েছিল। ১৮৭৭ সালে বয়স ২১ থেকে কমিয়ে ১৯ বছর করা হলে ভারতীয় ছাত্রদের পক্ষে পরীক্ষা দেওয়া অসম্ভব হয়ে যায়। এর বিরুদ্ধে সুরেন্দ্রনাথ প্রতিবাদ জানান, ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বক্তৃতা দিয়ে জনমত গড়ে তোলেন এবং বিভিন্ন প্রদেশের রাজনৈতিক সংগঠনগুলির সাথে যোগাযোগ করে তাদের আন্দোলনের অংশ করে তোলেন। এই আন্দোলন সফল হয় এবং ইংরেজ সরকার সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে আন্দোলনের গুরুত্ব উপলব্ধি করে পরীক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়।
- দেশীয় ভাষায় সংবাদপত্র আইন ও অস্ত্র আইনের বিরোধিতা: ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতবাসীর জনমত রুদ্ধ করার জন্য দেশীয় ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলির উপর বিধিনিষেধ আরোপিত হয়। এছাড়া অস্ত্র আইন বলবৎ করে ভারতীয়দের আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্র সংগ্রহ নিষিদ্ধ করা হয়। ভারত সভা এর বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে আন্দোলন শুরু করে।
- ইলবার্ট বিল আন্দোলন: বিচার ব্যবস্থায় ভারতীয় ও ইউরোপীয়দের মধ্যে বৈষম্য দূর করার জন্য উদারপন্থী বড়লাট লর্ড রিপন ‘ইলবার্ট বিল’ নামে এক আইনের পরিকল্পনা করেন। ইলবার্টের প্রস্তাব প্রকাশিত হওয়ার পর ইউরোপীয়রা প্রতিবাদে মুখর হলে সুরেন্দ্রনাথ এই প্রতিবাদের প্রত্যুত্তরে এবং ইলবার্ট বিলের সপক্ষে দেশ জুড়ে আন্দোলন গড়ে তোলেন। যদিও শেষ পর্যন্ত ইউরোপীয়দের স্বার্থ সুরক্ষিত করে বিলটি সংশোধন করা হয় এবং মূল আদর্শ ব্যর্থ হয়, তবুও ভারত সভা পরিচালিত আন্দোলন ভারতীয়দের জাতীয়তাবোধে উজ্জীবিত করে তোলে।
ঘ. জাতীয়তাবাদী ভাবধারা প্রচারের ক্ষেত্রে হিন্দুমেলার অবদান সম্পর্কে লেখো।
উত্তর: উনিশ শতকে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার একদিকে জাতীয়তাবাদী ভাবধারা বিকাশের সহায়ক হলেও, অন্যদিকে পাশ্চাত্য শিক্ষা, সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণ যুবসমাজকে নিজের ঐতিহ্য থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। এই অবস্থায় রাজনারায়ণ বসু, নবগোপাল মিত্র, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ বাঙালি মনীষীরা যুবসমাজে জাতীয়তাবাদের প্রসার ঘটানোর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। দেশের যুবসমাজকে ঐতিহ্যমুখী করে তুলে জাতীয়তাবাদী ভাবধারা প্রসারের উদ্দেশ্যেই হিন্দুমেলার জন্ম হয়।
হিন্দুমেলার প্রথম অধিবেশন বসেছিল ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দের চৈত্র সংক্রান্তিতে। প্রথমে এর নাম ছিল চৈত্রমেলা, পরে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় হিন্দুমেলা। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার হিন্দুমেলার তিনটি উদ্দেশ্যের কথা বলেছেন—জাতীয় ভাবের প্রসার ঘটানো, জনগণের মধ্যে দেশাত্মবোধের ভাবনা জাগিয়ে তোলা ও হিন্দুদের মধ্যে আত্মনির্ভরতার মনোভাব গড়ে তোলা। হিন্দুমেলার প্রথম অধিবেশনে নানা প্রকার কর্মসূচি গৃহীত হয়েছিল, যেমন—হিন্দুদের মধ্যে ঐক্যস্থাপন, হিন্দু সমাজের উন্নয়নসাধন, ‘স্বজাতীয় বিদ্যানুশীলনের উন্নতিসাধনে নিয়োজিত’ ব্যক্তিদের সম্মানিত করা, প্রত্যেক মেলায় দেশের বিভিন্ন স্থানের শিল্পজাত পণ্য প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা ইত্যাদি। এছাড়াও হিন্দুমেলায় শরীরচর্চার বিষয়েও উৎসাহদান করা হয়।
হিন্দুমেলার স্বদেশি ভাবধারার আনুকূল্যে নবগোপাল মিত্র ন্যাশনাল স্কুল, ন্যাশনাল সোসাইটি, ন্যাশনাল জিমনাসিয়াম স্থাপন করেন। ন্যাশনাল থিয়েটার স্থাপনেও হিন্দুমেলার প্রভাব ছিল। হিন্দুমেলা নিছক হিন্দুধর্মের প্রতিষ্ঠান ছিল না, এর মূল লক্ষ্য ছিল স্বদেশ ভাবনার প্রসার।
হিন্দুমেলা চোদ্দো বছর ধরে চলেছিল। জাতীয়তাবাদী ভাবধারা প্রসারে এর অবদান ছিল অনস্বীকার্য। হিন্দুমেলার দ্বারা বাংলা ভাষার প্রসার ঘটে। বাংলার বুদ্ধিজীবী সমাজ বুঝতে পারে জাতীয় ভাষার উন্নতি ছাড়া কোনো জাতির উন্নতি হতে পারে না। এই মেলা দেশীয় শিল্প-সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। হিন্দুমেলা জাতির মনে আত্মনির্ভরতার বীজ বপন করে, যা পরবর্তীকালে স্বদেশি আন্দোলনের ভাবনাকে অণুপ্রাণিত করেছিল। কিশোর বয়সেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হিন্দু মেলার অধিবেশনে কবিতা রচনা করে আবৃত্তি করেন এবং জাতীয়তাবোধে অনুপ্রাণিত হন।
ঙ. ‘গোরা’ উপন্যাসের মধ্য দিয়ে স্বদেশভাবনা, জাতীয়তাবোধ কীভাবে ফুটে উঠেছে তা আলোচনা করো।
উত্তর: ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গোরা’ উপন্যাসটি ইংরেজ শাসিত ভারতবর্ষের এক বিশেষ অধ্যায়কে তুলে ধরে। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে স্বদেশি আন্দোলনের কারণে সারা বাংলা যখন দেশাত্মবোধের উন্মাদনায় অনুপ্রাণিত ও আলোড়িত, নায়ক গোরা সেই ভাবোন্মাদনার প্রতিমূর্তি। স্বদেশি আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং উপন্যাসের নায়ক গোরার মধ্যে স্বদেশ-ভাবনা ও জাতীয়তাবোধ তিনি নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই সঞ্চারিত করেছেন।
উপন্যাসে একদিকে স্বদেশি আন্দোলনে চরমপন্থী নামে পরিচিত জাতীয়তাবাদীদের উগ্রতা, অন্যদিকে নরমপন্থী কংগ্রেস রাজনীতির শহরকেন্দ্রিক অবস্থান—এই দুইটি বিষয় রবীন্দ্রনাথকে পীড়িত করে। রবীন্দ্রনাথ শহরের শিক্ষিত মানুষ ও অগণিত বঞ্চিত গ্রামীণ মানুষের মধ্যে বিস্তর দূরত্ব অনুভব করে দেখিয়েছেন যে, কলকাতার শিক্ষিত ভদ্রসমাজের বাইরে নিভৃত প্রকাণ্ড গ্রাম্য ভারতবর্ষ কত বিচ্ছিন্ন, সংকীর্ণ ও দুর্বল। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন এই বিচ্ছিন্ন ‘ভারতবর্ষ’ই এ দেশের বাস্তব রূপ এবং একে অবহেলা করে দেশের মুক্তি সম্ভব নয়।
‘গোরা’ চরিত্রের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড তাকে স্বদেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা করে তুলেছে। ইংরেজ শাসনের প্রতি গোরার বিদ্রোহী মনোভাব বিভিন্নভাবে ফুটে উঠেছে, যেমন স্কুলে পড়ার সময় ‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে’ আবৃত্তি করা বা পথে সাহেব দেখলে তাদের তাড়া করা। গোরা যৌবনের আবেগে ও দেশপ্রেমের উন্মাদনায় হিন্দুধর্মকে আশ্রয় করে জাতীয়তাবাদের পথ সন্ধান করে। উনিশ শতকের মধ্যভাগের পরে হিন্দুধর্ম রক্ষার তাগিদে সনাতন পথে জাতীয়তাবাদ প্রসারের উদ্যোগ দেখা গিয়েছিল, যা কিশোর রবীন্দ্রনাথ হিন্দুমেলায় প্রত্যক্ষ করেছিলেন। গোরার মধ্যে হিন্দুধর্মীয় পথে জাতীয়তাবোধের উৎসাহ আসলে রবীন্দ্রনাথের অভিজ্ঞতার ফসল।
গোরা একসময় নিজের আইরিশ মাতার সন্তান হওয়ার জন্মপরিচয় জানতে পেরে এক নতুন সত্যের উপলব্ধি লাভ করে। জাতি-বর্ণ-ধর্ম-এর সংকীর্ণ গণ্ডিকে অতিক্রম করে সে নিজেকে ‘ভারতবর্ষীয়’ বলে পরিচয় দেয়। সে বলে, “ভারতবর্ষের সকলের জাতই আমার জাত, সকলের অন্নই আমার অন্ন।” স্বামী বিবেকানন্দের সর্বধর্ম সমন্বিত জাতীয়তাবোধের ভাবনাই রবীন্দ্রনাথ এখানে তুলে ধরেছেন। গোরা সেই দেবতার মন্ত্রে দীক্ষিত হতে চায় “যিনি কেবল হিন্দুর দেবতা নন, যিনি ভারতবর্ষের দেবতা”। রবীন্দ্রনাথের এই ভাবনাই গোরা রচনার অব্যবহিত পরেই রচিত ‘ভারততীর্থ’ কবিতায় ফুটে ওঠে—”হে মোর চিত্ত, পুণ্য তীর্থে জাগো রে ধীরে/এই ভারতের মহামানবের সাগর তীরে।” উপন্যাসে পরেশবাবু ভারতবর্ষের মুক্ত প্রশান্ত ভাবনার প্রতিফলন এবং আনন্দময়ী সংস্কারমুক্ত ভারত জননী। গোরা সেই ভারতের মুক্ত মানব।
অতিরিক্ত (Extras)
বহুনির্বাচনী প্রশ্ন (MCQs)
১. ১৮৫৭-র বিদ্রোহের সূচনা কখন ঘটেছিল?
ক. ১১ই মে
খ. ২৯ মার্চ
গ. ২০ সেপ্টেম্বর
ঘ. ১ নভেম্বর
উত্তর: ক. ১১ই মে
৩৭. ‘স্বদেশ মন্ত্র’ প্রবন্ধে বিবেকানন্দের আহ্বান কী ছিল?
ক. জাতিগত ঐক্য
খ. ধর্মীয় বিভেদ
গ. অর্থনৈতিক উন্নতি
ঘ. শিক্ষাগত পরিবর্তন
উত্তর: ক. জাতিগত ঐক্য
প্রশ্ন ও উত্তর (Questions, Answers)
১. ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের সূচনা কোন সেনা ছাউনিতে হয়েছিল?
উত্তর: ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের সূচনা কলকাতার উত্তরে ব্যারাকপুর সেনা ছাউনিতে হয়েছিল।
৪২. ঊনবিংশ শতকের বাংলায় লেখায় ও রেখায় জাতীয়তাবোধের বিকাশের প্রক্রিয়া আলোচনা করো, বিশেষত সাহিত্য ও চিত্রকলায় এর প্রকাশ বিশ্লেষণ করো।
উত্তর: ঊনবিংশ শতকে শিক্ষিত বাঙালির মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা ও জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটে। ইংরেজ শাসন সম্পর্কে সম্পূর্ণ মোহমুক্ত হয়ে তারা প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠে। বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন, সভা, সমিতি প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে দিকে দিকে জাতীয়তাবাদী ভাবধারার প্রসার ঘটতে থাকে। শিক্ষিত বাঙালি সমাজ ভারতবাসীকে জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে প্রয়াসী হয়। কখনও কলমের আঁচড়ে আবার কখনও তুলির টানে ফুটে ওঠে স্বদেশের প্রতি তীব্র আবেগ। বাঙালির লেখায় রেখায় বিকশিত হয়ে ওঠে জাতীয়তাবোধ তথা স্বদেশ ভাবনা।
সাহিত্যে জাতীয়তাবোধ (লেখায়):
দিনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পন’, নবীনচন্দ্র সেনের ‘পলাশীর যুদ্ধ’ প্রভৃতি নাটক দেশবাসীকে জাতীয়তাবাদী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ করে তোলে। রঙ্গলাল বন্দোপাধ্যায় লেখেন-‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়।’ ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের স্বদেশ-প্রেম বিষয়ক কবিতাগুলি মানুষকে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করে তোলে। বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ, দেবী চৌধুরানী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গোরা প্রভৃতি উপন্যাস, স্বামী বিবেকানন্দের বর্তমান ভারত, জ্ঞানযোগ, রাজযোগ প্রভৃতি প্রবন্ধগুলি দেশবাসীর মধ্যে জাতীয়তাবাদের প্রসার ঘটায়।
সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে তাঁর ধারণার পরিচয় পাওয়া যায়। এই উপন্যাসে আঠারো শতকের শেষ দিকে বাংলার এক সংকটজনক সময়ের ছবি ফুটে উঠেছে। উত্তরবঙ্গের সন্ন্যাসী বিদ্রোহকে কাল্পনিক গৌরবময় ভূমিকায় স্থাপন করে বঙ্কিমচন্দ্র এই উপন্যাসে দেশাত্মবোধের জাগরণ ঘটিয়েছেন। ছিয়াত্তরের মন্বন্তর ও শাসকদের অত্যাচারে বিপর্যস্ত অসহায় মানুষদের রক্ষা করার জন্য সন্ন্যাসীরা বিদ্রোহ শুরু করেন। এই উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্রের জাতীয়তাবাদের বহিঃপ্রকাশ ঘটে চরমপন্থী আন্দোলনের মাধ্যমে। বঙ্কিম মনে করেছেন, দেশের শান্তি, শৃঙ্খলা ও আইনকানুনের অবনতি ঘটলে তা পুনরুদ্ধারের জন্য তথা দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রয়োজন ঐক্যবদ্ধ সশস্ত্র সংগ্রাম। আনন্দমঠের সন্তানদল সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীর মতো দেশমাতৃকাকে কালীরূপে আরাধনা করেছে। বঙ্কিমের ভাষায় যিনি দশভুজা তিনিই দেশমাতা। বঙ্কিমের জাতীয়তাবোধ ও জাতীয়তাবাদের অন্যতম প্রকাশ হল তাঁর ‘বন্দে মাতরম’ সংগীত। ভবানন্দ যখন গেয়ে ওঠেন ‘বন্দে মাতরম/সুজলাং সুফলাং মলয়জ শীতলাং শস্য শ্যামলাং মাতরম’-তখন দেশমাতাকে উদ্দেশ্য করেই এই গান রচিত হয়েছে। পরবর্তীকালে এই সংগীত জাতীয় আন্দোলনের রণসংগীতে পরিণত হয়। স্বদেশি যুগ থেকে বাংলার বিপ্লববাদী আন্দোলনে ও তারপর জাতীয় গণ-আন্দোলনে ‘বন্দে মাতরম’ বরাভয় মন্ত্র হিসাবে দেশবাসীকে উজ্জীবিত করে তোলে। বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ বাঙালি জাতিকে জাতীয়তাবোধের মন্ত্রে দীক্ষিত করে।
ঊনিশ শতকের শেষ দশকে স্বামী বিবেকানন্দ ধর্ম আন্দোলনে নতুন প্রাণসঞ্চার করেন। বিবেকানন্দের জাতীয়তাবোধ ধর্মীয় ভাবনার সঙ্গে বিশেষভাবে যুক্ত। বিবেকানন্দ সর্বধর্ম সমন্বিত এক ঐক্যবদ্ধ ভারত নির্মাণের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি অনুভব করেছিলেন যে ভারতবাসী যদি জাতি, ধর্ম, ভাষা ইত্যাদির বিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হতে না পারে তবে ভারতের মুক্তি সম্ভব নয়। বিবেকানন্দের এই জাতীয়তাবোধের প্রকাশ ঘটেছে ‘বর্তমান ভারত’ প্রবন্ধটিতে। ‘বর্তমান ভারত’ প্রবন্ধে স্বামীজির স্বদেশের প্রতি আবেগ ফুটে উঠেছে। ‘স্বদেশ মন্ত্র’ শীর্ষক অনুচ্ছেদটিতে আত্মবিশ্বাসহীন, দুর্বল ভারতবর্ষের প্রতি স্বামীজি ধিক্কার জানিয়েছেন। তিনি ভারতবাসীকে জড়তা, অলসতা, হীনমন্যতা ত্যাগ করে আত্মশক্তিতে জেগে ওঠার ডাক দেন। দেশবাসীকে স্বদেশচেতনায় উদ্বুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে ঘোষণা করেন-“ভুলিও না, তুমি জন্ম হইতেই মায়ের জন্য বলিপ্রদত্ত।” বিবেকানন্দ বিশ্বাস করতেন জাতিভেদ, অস্পৃশ্যতা জাতির প্রাণশক্তিকে ক্ষয় করে। তিনি ভারতবাসীকে সংকীর্ণ জাতপাতের গণ্ডি অতিক্রম করে এক হওয়ার আহ্বান জানান। বিবেকানন্দের স্বদেশমন্ত্র ছিল দেশের প্রতি তীব্র ভালোবাসা, আবেগ। তিনি এই প্রবন্ধে লেখেন- “ভারতবাসী আমার প্রাণ, ভারতের দেবদেবী আমার ঈশ্বর, ভারতের সমাজ আমার শিশুশয্যা, আমার যৌবনের উপবন, আমার বার্ধক্যের বারাণসী।” দেশের সঙ্গে এই একাত্মবোধকেই তিনি ভারতবাসীর মধ্যে জাগ্রত করতে চেয়েছিলেন। ‘বর্তমান ভারত’ গ্রন্থ দেশপ্রেমিকদের জাতীয়তাবোধে অনুপ্রাণিত করে।
১৯১০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘গোরা’ উপন্যাসটির মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ইংরেজ শাসিত ভারতবর্ষের এক বিশেষ অধ্যায়কে আমাদের সামনে উপস্থিত করেছেন। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে স্বদেশি আন্দোলনের কারণে সারা বাংলা তখন দেশাত্মবোধের উন্মাদনায় অনুপ্রাণিত, আলোড়িত। নায়ক গোরা এই ভাবোন্মাদনার প্রতিমূর্তি। স্বদেশি আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং অংশগ্রহণ করেছিলেন। উপন্যাসের নায়ক গোরার মধ্যে স্বদেশ-ভাবনা, জাতীয়তাবোধকে রবীন্দ্রনাথ নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই সঞ্চারিত করেছেন। রবীন্দ্রনাথ শহরের শিক্ষিত মানুষ ও অগণিত বঞ্চিত গ্রামীণ মানুষের মধ্যে বিস্তর দূরত্ব অনুভব করে মনে করতেন এই বিচ্ছিন্ন ‘ভারতবর্ষ’ই এ দেশের বাস্তব রূপ এবং এই ‘ভারতবর্ষ’কে অবহেলা করে দেশের মুক্তি কোনোভাবেই সম্ভব নয়। ‘গোরা’ চরিত্রের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড তাকে স্বদেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা করে তুলেছে। ইংরেজ শাসনের প্রতি গোরার বিদ্রোহী মনোভাব বিভিন্নভাবে ফুটে উঠেছে। গোরা যৌবনের আবেগে ও দেশপ্রেমের উন্মাদনায় হিন্দুধর্মকে আশ্রয় করে জাতীয়তাবাদের পথ সন্ধান করে। গোরা একসময় নিজের জন্মপরিচয় জানতে পেরে জাতি-বর্ণ-ধর্ম-এর সংকীর্ণ গণ্ডিকে অতিক্রম করে সে নিজেকে ‘ভারতবর্ষীয়’ বলে পরিচয় দেয়। সে বলে, “ভারতবর্ষের সকলের জাতই আমার জাত, সকলের অন্নই আমার অন্ন।” স্বামী বিবেকানন্দের সর্বধর্ম সমন্বিত জাতীয়তাবোধের ভাবনাই রবীন্দ্রনাথ এখানে তুলে ধরেন। গোরা সেই দেবতার মন্ত্রে দীক্ষিত হতে চায় “যিনি কেবল হিন্দুর দেবতা নন, যিনি ভারতবর্ষের দেবতা”। রবীন্দ্রনাথের এই ভাবনাই গোরা রচনার অব্যবহতি পরেই রচিত একটি কবিতায় ফুটে ওঠে-হে মোর চিত্ত, পুণ্য তীর্থে জাগো রে ধীরে/এই ভারতের মহামানবের সাগর তীরে। রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসে পরেশবাবু ভারতবর্ষের মুক্ত প্রশান্ত ভাবনার প্রতিফলন, আনন্দময়ী সংস্কারমুক্ত ভারত জননী। গোরা সেই ভারতের মুক্ত মানব।
চিত্রকলায় জাতীয়তাবোধ (রেখায়):
স্বদেশি যুগে কবিতা, গান, উপন্যাস, নাটক রচনার পাশাপাশি জাতীয় শিক্ষা ও শিল্পকলার ক্ষেত্রেও স্বদেশি তথা দেশজ ভাবধারার প্রকাশ দেখা যায়। কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি শিল্প-সংস্কৃতি চর্চার পীঠস্থান হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিশীল ভাবনা ঠাকুরবাড়ির পরবর্তী প্রজন্মকে শিল্পকর্মে উৎসাহিত করে তোলে। চিত্রশিল্পের ক্ষেত্রে স্বদেশিয়ানার জোয়ার আনেন রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্র অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি চিত্রশিল্পে দেশীয় ঐতিহ্যকে অনুসরণ করে বেঙ্গল স্কুল বা ওরিয়েন্টাল আর্টের ভিত্তি স্থাপন করেন। স্বদেশি আন্দোলনের দেশজ ভাবধারার অভিঘাতে এই নতুন ঘরানার শিল্পকলার জন্ম হয়।
এই সময় অবনীন্দ্রনাথের আঁকা ‘ভারতমাতা’ চিত্রটি মানুষের মধ্যে উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। এই ছবিটির মধ্য দিয়ে অবনীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবোধ ফুটে উঠেছে। শিল্পীর ভাবনায়, ভারতমাতা গেরুয়া বসন পরিহিতা যোগিনী মূর্তি। তিনি বরাভয়দায়িনী। ত্যাগ ও বৈরাগ্যের মূর্ত প্রতীক। ভারতমাতার চার হাতে শোভা পায় রুদ্রাক্ষের মালা, শুভ্রবস্ত্র, পুঁথি ও শ্যামল শস্যগুচ্ছ। ভারতমাতা চিত্রটির মধ্য দিয়ে শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ধনধান্যপূর্ণ সমৃদ্ধশালী ভারতের ছবি আমাদের সামনে তুলে ধরতে চেয়েছেন। এই ভারতবর্ষ শিক্ষা-সংস্কৃতিতে উন্নত ভারতবর্ষ। ত্যাগ ও শান্তির আদর্শে মহিমান্বিত ভারতবর্ষ। ভারতমাতা চিত্রটি স্বদেশি যুগে বিভিন্ন সভা, সমাবেশে সজ্জিত হত। ভগিনী নিবেদিতা মডার্ন রিভিউ পত্রিকায় ছবিটির কল্পনা ও অনুভবের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠভ্রাতা গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর চিত্রশিল্পে এক ব্যতিক্রমী উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। সমকালীন সমাজ ও সময়ের ছবি শিল্পীর তুলির টানে ব্যঙ্গাত্মক রূপে ফুটে ওঠে। তিনি ছিলেন রবি বর্মার সমকালীন চিত্রকর। বাংলাদেশে তিনিই প্রথম ব্যঙ্গচিত্রকর হিসাবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তাঁর ব্যঙ্গচিত্রগুলিতে যেমন বিদেশি শাসকদের কটাক্ষ করা হয়, একই রকমভাবে সমাজের নানা অসংগতি ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গিমায় সেই চিত্রে ফুটে ওঠে। ঔপনিবেশিক শাসকদের কাছে মাথা নোয়ানো মানুষ বা শহুরে জীবনের কৃত্রিম সাহেবিয়ানা- যে-কোনো কিছুকেই তিনি বিদ্ধ করতেন তাঁর শ্লেষাত্মক কার্টুন চিত্রে। গগনেন্দ্রনাথ কোনো প্রকার তোষামোদে বিশ্বাস করতেন না। তাই তাঁর ব্যঙ্গচিত্র হয়ে উঠেছিল ঔপনিবেশিক সমাজের সমালোচনার প্রতিফলন। তাঁর ব্যঙ্গচিত্রগুলিতে বিদেশি শাসকদের পাশাপাশি দেশীয় নেতারাও ব্যঙ্গের আওতার মধ্যে পড়েছেন। এমনকি, রবীন্দ্রনাথও তাঁর ব্যঙ্গচিত্রের বিষয় হয়েছেন। বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর আবিষ্কার, প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের গবেষণা, রবীন্দ্রনাথের প্রথম বিমান চড়া, রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথের মন্ত্রিত্ব গ্রহণ ইত্যাদি নিয়ে কার্টুন চিত্রগুলি ইতিহাসের অমূল্য দলিল।
Get notes of other boards, classes, and subjects
Notify change in syllabus/books | Share PDFs of books, get benefits |
Request notes not available now | Share PDFs of question papers |