এখানে (chapter 2) সংস্কার ::বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা: WBBSE ক্লাস 10 ইতিহাস (History) (Bengali medium) আধুনিক ভারতের ইতিহাস ও পরিবেশ (Adhunik Bharater Itihas O Poribesh)-এর উত্তর, ব্যাখ্যা, সমাধান, নোট, অতিরিক্ত তথ্য, এমসিকিউ এবং পিডিএফ পাওয়া যাবে। নোটগুলো শুধুমাত্র রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করুন এবং প্রয়োজনমতো পরিবর্তন করতে ভুলবেন না।
Select medium |
English medium notes |
Bengali medium notes |
- সারাংশ (summary)
- পাঠ্য প্রশ্ন ও উত্তর (Prantik textbook)
- সঠিকউত্তরটি নির্বাচন করো
- নীচের বিবৃতিগুলির মধ্যে কোনটি ঠিক কোনটি ভুল লেখো
- নীচের বিবৃতির সঙ্গে সবচেয়ে মানানসই ব্যাখ্যাটি বেছে নাও
- প্রদত্ত ভারতবর্ষের মানচিত্রে নিম্নলিখিত স্থানগুলি চিহ্নিত করো
- বামস্তম্ভের সঙ্গে ডানস্তম্ভ মেলাও :
- একটি বাক্যে উত্তর দাও
- সংক্ষিপ্ত উত্তরধর্মী প্রশ্ন
- বিশ্লেষণধর্মী প্রশ্ন
- ব্যাখ্যাধর্মী প্রশ্ন
- অতিরিক্ত (Extras)
সারাংশ (summary)
উনিশ শতকে বাংলায় অনেক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক পরিবর্তন এসেছিল। ইংরেজ শাসন এবং তাদের নতুন আইনকানুন, বিশেষ করে জমির ব্যবস্থা, সাধারণ মানুষের জীবনে অনেক সমস্যা তৈরি করেছিল। কিন্তু এই সময়েই পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে এক নতুন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্ম হয়। এই শ্রেণি কুসংস্কার ছেড়ে যুক্তিবাদী হয়ে ওঠে এবং পাশ্চাত্যের ভালো আদর্শগুলো যেমন মানবতাবাদ, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ইত্যাদি শেখে।
প্রথমে এই শিক্ষিত বাঙালিরা ইংরেজ শাসনের সমর্থক থাকলেও, পরে তারা বুঝতে পারে যে ইংরেজরা আসলে শোষণ করছে। তখন তারা এর বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করে। উনিশ শতকের বাংলা সংবাদপত্র, সাময়িকপত্র এবং সাহিত্য সমাজের বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছিল। এগুলোকে তৎকালীন সমাজের আয়না (ayna – meaning mirror) বলা যেতে পারে, কারণ এগুলো সমাজের ভালো-মন্দ সব দিকই দেখাতো। নীলচাষিদের কষ্ট, সতীদাহ প্রথা, বিধবাদের দুঃখ, নারীশিক্ষা, বাবু কালচার ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে লেখালেখি হতো। ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’ (Bamabodhini Patrika) নারীদের কথা বলত, ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ (Hindu Patriot) নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে লিখেছিল, কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ (Hutom Pyanchar Naksha) কলকাতার ধনী সমাজের সমালোচনা করেছিল, আর দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীল দর্পণ’ (Neel Darpan) নাটক নীল বিদ্রোহের করুণ চিত্র এঁকেছিল।
এই সময়ে শিক্ষা ক্ষেত্রেও অনেক পরিবর্তন আসে। প্রথমে প্রাচ্য (ভারতীয়) না পাশ্চাত্য (ইংরেজি) শিক্ষা ভালো, তা নিয়ে মতভেদ ছিল। পরে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার ঘটে। রাজা রামমোহন রায়, ডেভিড হেয়ার, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বেথুন সাহেব প্রমুখ ব্যক্তি এবং সরকারি উদ্যোগে অনেক স্কুল-কলেজ (যেমন হিন্দু কলেজ, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়) প্রতিষ্ঠিত হয়। বিদ্যাসাগর বিশেষভাবে নারীশিক্ষার জন্য অনেক স্কুল খোলেন।
সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে ব্রাহ্ম সমাজ (Brahmo Samaj) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রামমোহন রায় এর প্রতিষ্ঠা করেন। পরে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কেশবচন্দ্র সেন এর নেতৃত্ব দেন। ব্রাহ্ম সমাজ মূর্তিপূজা, জাতিভেদ এবং সতীদাহ প্রথার বিরোধিতা করে ও বিধবা বিবাহের পক্ষে বলে। রামমোহনের চেষ্টায় সতীদাহ প্রথা বন্ধ হয়। বিদ্যাসাগরের চেষ্টায় বিধবা বিবাহ আইনসিদ্ধ হয়। ডিরোজিওর নেতৃত্বে ‘নব্যবঙ্গ’ (Young Bengal) গোষ্ঠী যুক্তিবাদী চিন্তার প্রচার করলেও তাদের প্রভাব সীমিত ছিল।
ধর্ম সংস্কারে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব সব ধর্মকে সমান বলে ‘যত মত তত পথ’ (Joto Mot Toto Poth – meaning ‘As many opinions, so many paths’) এই ভাবনার কথা বলেন। তাঁর শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ ধর্মকে মানবসেবার (‘শিব জ্ঞানে জীব সেবা’ – Shiva Gyane Jiva Seva – meaning ‘Serving beings knowing they are Shiva’) কাজে লাগানোর কথা বলেন এবং নতুন ভারত গড়ার স্বপ্ন দেখেন।
এই পুরো সময়টাকে অনেকে ইতালির রেনেসাঁসের সাথে তুলনা করে ‘বাংলার নবজাগরণ’ (Banglar Nabajagaran) বলেন। তবে এর কিছু সীমাবদ্ধতাও ছিল, যেমন এটি মূলত কলকাতা-কেন্দ্রিক শিক্ষিত হিন্দুদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল এবং সাধারণ গরিব মানুষ বা মুসলিম সমাজকে ততটা স্পর্শ করতে পারেনি। এই অধ্যায়ের নাম ‘সংস্কার: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা’ (Sangskar: Boishishto o Porjalochona)।
পাঠ্য প্রশ্ন ও উত্তর (Prantik textbook)
সঠিকউত্তরটি নির্বাচন করো
ক) ওয়ারেন হেস্টিংসের শিক্ষানীতি ছিল—
(i) পাশ্চাত্যবাদী
(ii) সমন্বয়বাদী
(iii) প্রাচ্যবাদী
(iv) কোনোটাই নয় ৷
উত্তর: (iii) প্রাচ্যবাদী
খ) পাশ্চাত্য শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে ইংরেজির সঙ্গে মাতৃভাষাকেও স্বীকৃতি দেওয়া হয়—
(i) লর্ড হার্ডিঞ্জের প্রতিবেদনে
(ii) মেকলের প্রতিবেদনে
(iii) জেনারেল অকল্যান্ডের প্রতিবেদনে
(iv) চার্লস উডের প্রতিবেদনে
উত্তর: (iv) চার্লস উডের প্রতিবেদনে
গ) কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ছিলেন—
(i) জেমস উইলিয়ম কোলভিল
(ii) লর্ড ক্যানিং
(iii) ডেভিড হেয়ার
(iv) মন্টফোর্ড ব্রামলি।
উত্তর: (i) জেমস উইলিয়ম কোলভিল
ঘ) হিন্দু প্যাট্রিয়টের সম্পাদক ছিলেন
(i) দীনবন্ধু মিত্র
(ii) রামমোহন রায়
(iii) হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়
(iv) ভবানীচরণ মুখোপাধ্যায়
উত্তর: (iii) হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়
ঙ) ব্রাত্ম আন্দোলনে বিভাজন সৃষ্টি হওয়ার কারণ ছিল—
(i) তরুণ সদস্যদের সঙ্গে প্রাচীনপন্থীদের আদর্শগত মতানৈক্য
(ii) তরুণ সদস্যদের সামাজিক সংস্কারের প্রতি ঝোঁক
(iii) তরুণ সদস্যদের প্রগতিশীল ভাবনা
(iv) এই সবকটাই।
উত্তর: (iv) এই সবকটাই।
নীচের বিবৃতিগুলির মধ্যে কোনটি ঠিক কোনটি ভুল লেখো
১. আলালের ঘরের দুলাল গ্রন্থটির রচয়িতা ছিলেন কালীপ্রসন্ন সিংহ।
উত্তর: ভুল
কারণ: আলালের ঘরের দুলাল গ্রন্থটির রচয়িতা হলেন প্যারীচাঁদ মিত্র, না কালীপ্রসন্ন সিংহ। এটি উনিশ শতকের একটি উল্লেখযোগ্য বাংলা উপন্যাস।
২. ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে জোনাথান ডানকানের উদ্যোগে এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয়।
উত্তর: ভুল
কারণ: এশিয়াটিক সোসাইটি ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে উইলিয়াম জোন্সের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়। জোনাথান ডানকান বা ১৭৮১ সালের কোনো উল্লেখ নেই।
৩. নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর ‘জ্ঞানান্বেষণ’ পত্রিকা নারী শিক্ষা ও নারীমুক্তি বিষয়ে সদর্থক ভূমিকা পালন করেছিল।
উত্তর: ঠিক
কারণ: নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর ‘জ্ঞানান্বেষণ’ পত্রিকা সমাজ সংস্কার আন্দোলনের অংশ হিসেবে নারী শিক্ষা ও নারীমুক্তি বিষয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল। এই পত্রিকা মাধ্যমে নারী শিক্ষা বিস্তারের প্রচার চালানো হয়েছিল।
৪. রামমোহন রায় পাঠক্রমে বেদান্ত, ন্যায়শাস্ত্র প্রভৃতি বিষয়গুলিকে অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছিলেন।
উত্তর: ভুল
কারণ: রামমোহন রায় পাঠক্রমে বেদান্ত ও ন্যায়শাস্ত্রের পরিবর্তে দর্শন, অঙ্ক, রসায়ন প্রভৃতি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছিলেন। তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে উৎসাহী ছিলেন।
৫. ব্রাত্ম সমাজ ছিল একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী।
উত্তর: ঠিক
কারণ: ব্রাত্ম সমাজ একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী ছিল এবং এটি হিন্দুধর্মের আচার-সর্বস্বতা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল। একেশ্বরবাদ ছিল এই সমাজের মূল আদর্শ।
নীচের বিবৃতির সঙ্গে সবচেয়ে মানানসই ব্যাখ্যাটি বেছে নাও
(ক) উনিশ শতকেবাংলায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির আবির্ভাব হয়। ব্যাখ্যা :
(i) এইসময় প্রাচ্যশিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি
(ii) এই সময় পাশ্চাত্য শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রসার ঘটে।
(ii) বাঙালিরা নিজস্ব শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রতি বিশেষ যত্নবান হয়ে ওঠে।
সঠিক ব্যাখ্যা: (ii) এই সময় পাশ্চাত্য শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রসার ঘটে।
কারণ: পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসার ফলে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত সম্প্রদায় কুসংস্কারমুক্ত ও যুক্তিবাদী হয়ে ওঠে এবং একটি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব ঘটে।
(খ) উনিশ শতকে শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে রাধাকান্ত দেব ছিলেন স্বতন্ত্র ভাবনার অনুসারী। ব্যাখ্যা :
(i) তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষা-সভ্যতার অন্ধ অনুকরণে বিশ্বাসী ছিলেন।
(ii) প্রাচ্যবাদকেই তিনি শিক্ষার অনুকূল বলে মনে করেছিলেন।
(iii) কেবলমাত্র বৈষয়িক উন্নতির জন্য তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটাতে চেয়েছিলেন।
সঠিক ব্যাখ্যা: (iii) কেবলমাত্র বৈষয়িক উন্নতির জন্য তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটাতে চেয়েছিলেন।
কারণ: রাধাকান্ত দেব পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণ না করে কেবলমাত্র বৈষয়িক উন্নতির জন্য পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটাতে চেয়েছিলেন, কারণ তিনি মনে করতেন এর ফলে পাশ্চাত্য শিক্ষার আলো আরও বিস্তার লাভ করবে।
(গ) রামকৃষ্ণদেবের ধর্মভাবনার সারকথা ছিল সর্বধর্মসমন্বয়। ব্যাখ্যা :
(i) তিনি মনে করতেন যে বাহ্যিক প্রভেদ সত্ত্বেও সকল ধর্মের মধ্যে মূলগত ঐক্য বর্তমান।
(ii) তিনি অনেক ধর্মগ্রন্থ পাঠ করেন।
(iii) তিনি একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী ছিলেন।
সঠিক ব্যাখ্যা: (i) তিনি মনে করতেন যে বাহ্যিক প্রভেদ সত্ত্বেও সকল ধর্মের মধ্যে মূলগত ঐক্য বর্তমান।
কারণ: রামকৃষ্ণদেব বিভিন্ন ধর্ম সাধনার মাধ্যমে উপলব্ধি করেন যে, সকল ধর্মের মূল লক্ষ্য এক, ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়। তাই তিনি বলতেন ‘যত মত, তত পথ’।
প্রদত্ত ভারতবর্ষের মানচিত্রে নিম্নলিখিত স্থানগুলি চিহ্নিত করো
(ক) মুরশিদাবাদ
(খ) ঢাকা
(গ) মাদ্রাজ
(ঘ) বোম্বাই
বামস্তম্ভের সঙ্গে ডানস্তম্ভ মেলাও :
বামস্তম্ভ | ডানস্তম্ভ |
(i) আত্মীয় সভা | (a) নব্যবঙ্গ গোষ্ঠী |
(ii) Manmaking religion | (b) হিন্দু প্যাট্রিয়ট |
(iii) অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন | (c) রামমোহন রায় |
(iv) মন্টফোর্ড ব্রামলি | (d) স্বামী বিবেকানন্দ |
(v) ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন | (e) মেডিক্যাল কলেজ |
উত্তর:-
বামস্তম্ভ | ডানস্তম্ভ |
(i) আত্মীয় সভা | (a) রামমোহন রায় |
(ii) Manmaking religion | (b) স্বামী বিবেকানন্দ |
(iii) অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন | (c) নব্যবঙ্গ গোষ্ঠী |
(iv) মন্টফোর্ড ব্রামলি | (d) মেডিক্যাল কলেজ |
(v) ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন | (e) হিন্দু প্যাট্রিয়ট |
একটি বাক্যে উত্তর দাও
ক. ‘বামাবোধিনী’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এমন একজন লেখিকার নাম লেখো।
উত্তর: মানকুমারী বসু ‘বামাবোধিনী’ পত্রিকার একজন বিশিষ্ট লেখিকা ছিলেন।
খ. কত খ্রিস্টাব্দে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়?
উত্তর: ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়।
গ. শিক্ষা সংক্রান্ত কোন্ প্রতিবেদনে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সুপারিশ করা হয়েছিল?
উত্তর: ১৮৫৪ সালে বোর্ড অফ কন্ট্রোলের সভাপতি চার্লস উডের প্রতিবেদনে ভারতবর্ষে উচ্চশিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সুপারিশ করা হয়েছিল।
ঘ. রামমোহন রায় সম্পাদিত একটি পত্রিকার নাম লেখো।
উত্তর: রামমোহন রায় সম্পাদিত একটি পত্রিকার নাম হল ‘সম্বাদ কৌমুদী’।
ঙ. কত খ্রিস্টাব্দে সতীদাহ প্রথাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়?
উত্তর: ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে সতীদাহ প্রথাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
চ. কাদের উদ্যোগে ‘পার্থেনন’ নামে সাপ্তাহিক ইংরেজি পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল?
উত্তর: ডিরোজিওর অনুপ্রেরণায় নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর সদস্যরা ‘পার্থেনন’ নামে একটি সাপ্তাহিক ইংরেজি পত্রিকা প্রকাশ করেন।
সংক্ষিপ্ত উত্তরধর্মী প্রশ্ন
ক. নীল দর্পণ নাটকটি কার রচনা? কোন্ বিষয়কে অবলম্বন করে এই নাটক রচিত হয়েছিল?
উত্তর: নীল দর্পণ নাটকটির রচয়িতা হলেন নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র। এই নাটকটি নীলকর সাহেবদের অত্যাচার ও নীল বিদ্রোহের পটভূমিতে রচিত হয়েছিল। নীলকরদের নির্মম অত্যাচারে গোলক বসুর সম্পন্ন নিরীহ পরিবার এবং সাধুচরণ নামে এক বিশিষ্ট ভদ্র রায়তের বংশ ধ্বংসের করুণ কাহিনিকে অবলম্বন করে এই নাটকটি রচিত হয়েছে।
খ. প্রথম দিকে ইংরেজরা ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রচলনের পরিবর্তে প্রাচ্য শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছিলেন কেন?
উত্তর: প্রথমদিকে ইংরেজরা ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রচলনে ও সমাজসংস্কারে তেমন কোনো উৎসাহ দেখায়নি কারণ তাদের ভয় ছিল যে পাশ্চাত্য রীতিতে সমাজসংস্কার ভারতের সনাতন ঐতিহ্যকে আঘাত করতে পারে। এর ফলে ভারতবাসীর ইংরেজদের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকবে এবং ভারতে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্য বিপন্ন হবে।
গ. রামমোহন রায় ভারতীয় শিক্ষার পাঠক্রমে কী ধরনের পরিবর্তনে উৎসাহী ছিলেন?
উত্তর: রামমোহন রায় ভারতীয় শিক্ষার পাঠক্রমে বেদান্ত, ন্যায়শাস্ত্রের পরিবর্তে দর্শন, অঙ্ক, রসায়ন প্রভৃতি বিষয় রাখার জন্য জোর দেন।
ঘ. পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারে ডেভিড হেয়ারের দুটি অবদান উল্লেখ করো।
উত্তর: পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারে ডেভিড হেয়ারের দুটি অবদান হল:
(i) তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্টায় এবং তৎকালীন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি স্যার হাইড ইস্টের সহায়তায় ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু কলেজ স্থাপিত হয়।
(ii) তিনি কলকাতা স্কুল বুক সোসাইটি পরিচালনায় মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন এবং তাঁর উদ্যোগেই কলকাতায় একটি ইংরেজি উচ্চ বিদ্যালয় (বর্তমান হেয়ার স্কুল) প্রতিষ্ঠিত হয়।
ঙ. সতীদাহ প্রথা-বিরোধী আন্দোলনের জন্য রামমোহনকে কী ধরনের আক্রমণের সম্মুখীন হতে হয়েছিল?
উত্তর: সতীদাহ প্রথা-বিরোধী আন্দোলনের জন্য রামমোহনের শুভ প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে রক্ষণশীলদের ‘সংস্থা ‘ধর্মসভা’ সোচ্চার হয়ে ওঠে। তাদের বক্তব্য ছিল, সতীদাহ প্রথা হিন্দুশাস্ত্র সম্মত পালনীয় বিধি এবং সরকার এতে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।
চ. উনিশ শতকে ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের মূল বৈশিষ্ট্য কী ছিল?
উত্তর: উনিশ শতকের ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের মূল বৈশিষ্ট্য হল হিন্দুধর্মের পৌত্তলিকতা, আচারসর্বস্বতা, ধর্মীয় ভেদাভেদে আঘাত হেনে মানবধর্মের প্রতিষ্ঠা এবং সর্বধর্মের সমন্বিত রূপ হিসাবে একেশ্বরবাদকে তুলে ধরা।
ছ. রামকৃষ্ণদেবের ধর্মভাবনার মূল কথা কী?
উত্তর: রামকৃষ্ণদেবের ধর্মভাবনার মূল কথা ছিল মানবতা বা মানব হিতৈষণা এবং সর্বধর্ম সমন্বয়। তিনি বিশ্বাস করতেন ঈশ্বর এক ও অভিন্ন এবং সকল ধর্মের মধ্যে মূলগত ঐক্য বর্তমান। তাঁর মতে, ‘সব ধর্মই সত্য—যত মত তত পথ’। তাঁর কাছে মানবসেবা ছিল ঈশ্বর সেবারই নামান্তর, যা ‘শিবজ্ঞানে জীবসেবার’ আদর্শে প্রকাশিত।
জ. কত খ্রিস্টাব্দে স্বামী বিবেকানন্দ বেলুড়ে রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা করেন? এই প্রতিষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য কী ছিল?
উত্তর: স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে হাওড়া জেলার বেলুড়ে রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রতিষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য ছিল আধ্যাত্মিক উন্নতি ও সমাজসেবাকে আদর্শ করে অসহায় আর্ত পীড়িত মানুষের সেবার মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের সান্নিধ্যলাভের মহৎ আদর্শকে বাস্তবায়িত করা।
বিশ্লেষণধর্মী প্রশ্ন
ক. ‘বামাবোধিনী’ ছিল উনিশ শতকের নারী শিক্ষা ও নারী আন্দোলনের অন্যতম উল্লেখযোগ্য পত্রিকা—তুমি কি এই মন্তব্যকে সমর্থন করো? তোমার সমর্থনে যুক্তি দাও।
উত্তর: উনিশ শতকে বাংলার সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল নারী শিক্ষা ও নারীমুক্তি আন্দোলন। এই আন্দোলনের সমর্থনে উনিশ শতকে বেশ কিছু সাময়িকপত্র প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে ‘বামাবোধিনী’ পত্রিকার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ব্রাহ্ম সমাজ সংস্কারের ফসল হিসাবে এই পত্রিকার জন্ম হয়। ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে উমেশচন্দ্র দত্ত সম্পাদিত এই মাসিক পত্রিকাটিতে তৎকালীন সমাজে নারীমুক্তি আন্দোলন সম্পর্কিত জনমত গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। রক্ষণশীল সমাজের বুকে দাঁড়িয়ে এই পত্রিকা নারীর অধিকার ও নারী শিক্ষা সম্পর্কে সরব হয়ে ওঠে। প্রথম থেকে এতে ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান, গৃহ-চিকিৎসা, শিশুপালন ছাড়াও মনোরঞ্জক প্রবন্ধাদিও প্রকাশিত হত। নারীদের সাহিত্যরচনার জন্য উৎসাহিত করা হত। উৎকৃষ্ট লেখিকাকে পুরস্কৃত করারও ব্যবস্থা ছিল। এই পত্রিকার শিরোদেশে লেখা থাকত ‘কন্যাপ্যেবং পালনীয়া শিক্ষনীয়াতিযুক্ততঃ (কন্যাকে পালন করিবেন ও যত্নের সহিত শিক্ষা দিবেন।’) মানকুমারী বসু ছিলেন এই পত্রিকার বিশিষ্ট লেখিকা। কবিতা, উপন্যাস ও প্রবন্ধের মাধ্যমে তিনি নারী জীবনের দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণার কথা তুলে ধরেন। তাঁর রচিত ‘বিগত শতবর্ষে ভারত-রমণীদের অবস্থা’ প্রবন্ধটি তৎকালীন সমাজে ভারতীয় নারী জীবনের অসহনীয় দুরবস্থার কথা বর্ণনা করেছিল। বামাবোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত গল্প, কবিতাগুলি সমাজের ধর্মীয় গোঁড়ামি, বিধবাদের অবস্থা, বিধবা বিবাহ সম্পর্কে মানুষকে নতুন করে ভাবিয়ে তোলে। উনিশ শতকের ভারতীয় নারী সমাজের শিক্ষা ও সচেতনতা প্রসারে বামাবোধিনী পত্রিকার উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল। সুতরাং, ‘বামাবোধিনী’ উনিশ শতকের নারী শিক্ষা ও নারী আন্দোলনের অন্যতম উল্লেখযোগ্য পত্রিকা ছিল, এই মন্তব্যটি সমর্থনযোগ্য।
খ. ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ পত্রিকা তার সময়ে কেন ব্যতিক্রমী বলে বিবেচিত হয়েছিল?
উত্তর: ঊনবিংশ শতকের অধিকাংশ পত্রপত্রিকাই কলকাতা শহর থেকে প্রকাশিত হত। তাই সেইসব পত্রপত্রিকায় শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির চিন্তা ও চেতনার প্রতিফলন ঘটেছিল। কিন্তু ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ ছিল একটি ব্যতিক্রমী পত্রিকা। শহর থেকে অনেক দূরে বর্তমান বাংলাদেশের কুষ্ঠিয়া জেলার কুমারখালি গ্রাম থেকে এটি প্রকাশিত হত। প্রথাগত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত, তথাকথিত অশিক্ষিত কাঙাল হরিনাথ ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে এই পত্রিকা প্রকাশ করেন। শহুরে পত্রপত্রিকায় গ্রামের মানুষ ছিল উপেক্ষিত। তাই গ্রামীণ সমাজ ও গ্রামের মানুষের স্বার্থরক্ষা করতে এই পত্রিকার আবির্ভাব হয়। কাঙাল হরিনাথ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার নিরিখে গ্রামীণ মানুষের দুঃখ, দুর্দশা, বঞ্চনা ও নিপীড়নের কথা এই পত্রিকার মধ্য দিয়ে তুলে ধরেন। এই পত্রিকায় গ্রামীণ জীবনে শোষণের ভয়াবহ রূপ পরিবেশিত হত। নীলকর সাহেবদের নির্মম অত্যাচার থেকে জমিদার-মহাজনদের নির্লজ্জ আর্থিক শোষণের কাহিনি-সমস্ত কিছুই এই পত্রিকায় তীব্রভাবে সমালোচিত হয়। পাবনা বিদ্রোহের সময় কলকাতার ‘সোমপ্রকাশ’, ‘অমৃতবাজারের’ মতো বিখ্যাত পত্রিকা প্রজাদের সমর্থন জানায়নি। কিন্তু ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ নিরবচ্ছিন্নভাবে জমিদারদের নির্মম অত্যাচারের স্বরূপ প্রকাশ করতে থাকে। বিখ্যাত ঠাকুরবাড়ির জমিদারদের ভূমিকাও সমালোচনার হাত থেকে রেহাই পায়নি। গ্রামীণ সমাজ ও জীবনের বাস্তব চিত্র তুলে ধরে এই পত্রিকা তৎকালীন শহুরে পত্রিকার মাঝে নিজের এক ব্যতিক্রমী, স্বতন্ত্র জায়গা তৈরি করে নিয়েছিল। এই কারণগুলির জন্যই ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ তার সময়ে ব্যতিক্রমী বলে বিবেচিত হয়েছিল।
গ. উনিশ শতকের প্রাচ্য-পাশ্চাত্য শিক্ষা বিষয়ক দ্বন্দ্বটি সম্পর্কে লেখো।
উত্তর: আঠারো শতকের শেষদিকে বিভিন্ন কারণে এদেশে ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তনের দাবি উঠতে থাকে। শিক্ষার মাধ্যম কী হওয়া উচিত এই নিয়ে প্রাচ্যবাদী ও পাশ্চাত্যবাদীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে যায়। প্রাচ্যবাদীরা ভারতের সনাতন বা প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থাকেই গুরুত্ব দিতে চান। অন্যদিকে পাশ্চাত্যবাদীরা পাশ্চাত্য শিক্ষা তথা ইংরাজি শিক্ষাকেই শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে প্রচলন করতে উদ্যোগী হয়ে ওঠেন। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ভাবনার মধ্যে শিক্ষার সঠিক মাধ্যম কোন্টি হবে তা নিয়ে যখন তীব্র মতভেদ দেখা দিল, তখন মেকলের শিক্ষা বিষয়ক প্রতিবেদন প্রাচ্যবাদী ধ্যানধারণায় চূড়ান্ত আঘাত হানে। মেকলের বদ্ধমূল ধারণা ছিল ইংরেজরাই বিশ্বের সাংস্কৃতিক উন্নয়নের অগ্রদূত। এই একপেশে মনোভাব তাঁর শিক্ষানীতিকেও প্রভাবিত করল। ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের ২ ফেব্রুয়ারি তিনি ঘোষণা করলেন, শিক্ষার প্রাথমিক উদ্দেশ্য হবে একদল শিক্ষিত মধ্যবিত্ত তৈরি করা। এরা বর্ণে ও রক্তে হবে ভারতীয় কিন্তু রুচি, আদর্শ, চিন্তায় হবে ইংরেজ। তিনি ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান শেখানোর পরামর্শ দেন। ঘোষণা করেন, যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান ভারতীয় ভাষায় শিক্ষাদান করবে তারা কোনো সরকারি অনুদান পাবে না। তৎকালীন বুদ্ধিজীবীরা এর তীব্র প্রতিবাদ করেন। ইংরেজ প্রাচ্যবাদীরাও এই শিক্ষানীতির সমালোচনা করেন। অবশেষে প্রাচ্যবাদ-পাশ্চাত্যবাদ দ্বন্দ্বের অবসান হয়। ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দের ২৪ নভেম্বরে প্রকাশিত প্রতিবেদনে গভর্নর জেনারেল অকল্যান্ড জানান, ইংরেজি শিক্ষা প্রসারের পাশাপাশি প্রাচ্যবাদী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকেও আর্থিক সাহায্য করা হবে। দেশীয় ভাষা এবং ইংরেজি ভাষা উভয়ের মাধ্যমেই শিক্ষা দেওয়া হবে। শিক্ষার্থীরা নিজের পছন্দ এবং সুবিধামতো মাধ্যম বেছে নিতে পারবে।
ঘ. উনিশ শতকে ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে ব্যক্তিগত উদ্যোগের পরিচয় দাও।
উত্তর: প্রাথমিকভাবে পাশ্চাত্য শিক্ষায় আস্থাশীল কিছু যুক্তিবাদী মানুষ এবং খ্রিস্টান মিশনারিদের উদ্যোগে বাংলায় ইংরেজি শিক্ষার সূচনা হয়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য রাজা রামমোহন রায়, রাধাকান্ত দেব, উইলিয়ম কেরি, ডেভিড হেয়ার, জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বিটন, আলেকজান্ডার ডাফ প্রমুখ। ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে উইলিয়াম কেরি বাংলায় আসেন। তিনি মার্শম্যান এবং উইলিয়ম ওয়ার্ড নামে দুই ধর্মপ্রচারকের সাহায্যে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে ‘ব্যাপটিস্ট মিশন’ স্থাপন করেন। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুর কলেজের প্রতিষ্ঠা হয়। ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত হয় হিন্দু কলেজ। এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ডেভিড হেয়ার এবং রাজা রামমোহন রায়। হেয়ারের উদ্যোগেই প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ইংরেজি উচ্চ বিদ্যালয়’ (বর্তমান হেয়ার স্কুল) এবং ‘স্কুল বুক সোসাইটি’। ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে আলেকজান্ডার ডাফ কলকাতায় অনেকগুলি মিশনারি স্কুল স্থাপন করেছিলেন। এর মধ্যে বিখ্যাত ছিল জেনারেল অ্যাসেম্বলি ইন্সটিটিউশন (১৮৩০ খ্রি.)। পরবর্তীকালে এটি স্কটিশ চার্চ কলেজ নামে পরিচিত হয়। ডেভিড হেয়ার পেশায় ছিলেন একজন ঘড়ি ব্যবসায়ী। বেসরকারি উদ্যোগে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ডেভিড হেয়ারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় এবং তৎকালীন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি স্যার হাইড ইস্টের সহায়তায় ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু কলেজ স্থাপিত হয়। এছাড়া তিনি কলকাতা স্কুল বুক সোসাইটি পরিচালনায় মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। এই সোসাইটির উদ্দেশ্য ছিল ছাত্র উপযোগী পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ করা। স্কুল বুক সোসাইটির উদ্যোগে অনেক নতুন বিদ্যালয় গড়ে ওঠে। ডেভিড হেয়ার কলকাতায় একটি ইংরেজি উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন বর্তমানে যা হেয়ার স্কুল নামে প্রসিদ্ধ। কলকাতায় মেডিক্যাল কলেজ স্থাপিত হলে ডেভিড হেয়ার সেখানে পরিচালক সংস্থার সচিব পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন। জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বিটন বা বেথুন সাহেব ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে বড়োলাটের আইন সচিবের দায়িত্বভার গ্রহণ করে ভারতবর্ষে আসেন। সরকারের শিক্ষা পরিষদের সভাপতি পদে নিযুক্ত হয়ে তিনি এদেশে নারী শিক্ষা প্রসারে উদ্যোগী হয়ে ওঠেন। তাঁর এই উদ্যোগ বাস্তব রূপ লাভ করে ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে ৭ মে ‘হিন্দু ফিমেল স্কুল’ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। এই স্কুলটি পরবর্তীকালে বেথুন স্কুল নামে প্রসিদ্ধ হয়।
ঙ. টীকা লেখো: নারী শিক্ষা ও বিদ্যাসাগর।
উত্তর: উনিশ শতকে নারী শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে সমাজসংস্কারকদের উজ্জীবিত করেছিল পাশ্চাত্য শিক্ষার মানবতাবাদী ও যুক্তিবাদী আলোয় নারী জীবনের অজ্ঞানতার অন্ধকারকে দূর করার চেষ্টা। বাংলায় নারী শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনিই প্রথম বাংলাদেশে হিন্দু নারী বিদ্যালয় স্থাপনে উদ্যোগী হন। শিক্ষা কাউন্সিলের তৎকালীন সভাপতি জে.ই.ডি বেথুনের ব্যক্তিগত পৃষ্ঠপোষকতায় এবং বিদ্যাসাগরের আন্তরিক প্রচেষ্টায় ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দের ৭ মে মেয়েদের জন্য বিদ্যালয় নির্মিত হয়। এই বিদ্যালয় পরবর্তীকালে বেথুন স্কুল নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। বিদ্যালয় পরিদর্শক থাকাকালীন ১৮৫৭-৫৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বিদ্যাসাগর নদিয়া, বর্ধমান, হুগলি জেলায় সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগে এবং খরচায় ৩৫টি মেয়েদের স্কুল নির্মাণ করেন। স্কুলগুলিতে সেই সময় ১৩০০০ ছাত্রী পড়াশোনা করত। পরবর্তীকালেও বিদ্যাসাগর বেশ কিছু মেয়েদের স্কুল তৈরি করেছিলেন। তাঁর সর্বশেষ প্রয়াস ছিল ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে মা ভগবতী দেবীর স্মৃতিতে নিজ গ্রাম বীরসিংহে ভগবতী বিদ্যালয় স্থাপন। যদিও সরকারি অনুদানের অভাবে পরবর্তীকালে অনেক স্কুলে নিয়মিত পঠনপাঠন ব্যাহত হয়েছে। কিন্তু উনিশ শতকের অবহেলিত নারী জাতিকে ‘আপন ভাগ্য জয় করিবার’ জন্য যে পথের সন্ধান তিনি দিয়েছেন, তা যুগ-কালের সীমা অতিক্রম করে এগিয়ে চলেছে।
চ. সমাজ সংস্কার আন্দোলনে ব্রাহ্ম সমাজ কী ধরনের ভূমিকা পালন করেছিল বলে তোমার মনে হয়।
উত্তর: ধর্ম তথা সমাজ সংস্কারের উদ্দেশ্যে ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে রামমোহন রায় ‘ব্রাহ্মসভা’ প্রতিষ্ঠা করেন। যা পরবর্তীকালে ব্রাহ্ম সমাজ (১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে) হিসেবে প্রসিদ্ধ হয়। ব্রাহ্ম সমাজ ছিল একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী এক অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান। হিন্দুধর্মের আচারসর্বস্বতা, মূর্তিপূজা, বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ, সহমরণ প্রথার বিরুদ্ধে এই সমাজ সক্রিয় আন্দোলন গড়ে তোলে। কুসংস্কারের বিরুদ্ধে জনমত তৈরির উদ্দেশ্যে ‘সম্বাদ কৌমুদী’ পত্রিকার মধ্য দিয়ে রামমোহন নিজের যুক্তি ও তত্ত্ব-তথ্য সমৃদ্ধ বক্তব্য তুলে ধরেন। রক্ষণশীল হিন্দুদের কড়া ভাষায় আক্রমণ করা হয়। রামমোহনের মৃত্যুর পর দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিচালনায় ব্রাহ্ম সমাজ নারী শিক্ষার উন্নয়ন, বহু বিবাহ রদ, বিধবা বিবাহের প্রবর্তন প্রভৃতি নানান সামাজিক বিষয় সম্পর্কে প্রচার চালায়। পরবর্তীকালে কেশবচন্দ্র সেনের উদ্যোগে ব্রাহ্ম-আন্দোলনের গতি ত্বরান্বিত হয়। কেশব সেন সমাজসেবা ও নানা উন্নয়নমূলক সংস্কারে ব্রতী হন। কেশবচন্দ্র ‘ভারতীয় ব্রাহ্মসমাজ’ নামে একটি পৃথক সংস্থা গঠন করেন। এই সংস্থায় নারীদের সভ্যপদ প্রদান করা হয় এবং প্রগতিশীল সমাজ সংস্কারের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে এই সংস্থার উদ্যোগে সরকার ‘তিন আইন’ পাস করে। এই আইনে বাল্য বিবাহ ও বহু বিবাহ নিষিদ্ধ হয়ে যায়। বিধবা বিবাহ ও অসবর্ণ বিবাহ আইনসিদ্ধ করা হয়। ব্রাহ্ম আন্দোলনের ফলে হিন্দু সমাজের প্রাচীন কুসংস্কারগুলি ধীরে ধীরে ভেঙে পড়তে থাকে। রক্ষণশীল গোষ্ঠীও সমাজ সংস্কার সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে। ব্রাহ্ম সমাজসমূহের দ্বারা গৃহীত পদক্ষেপগুলি ছিল প্রগতিশীলতার প্রতীক। নারীর সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন এবং সমাজের সার্বিক বিকাশের দিকে লক্ষ্য রেখেই পদক্ষেপগুলি গৃহীত হয়েছিল।
ছ. বিদ্যাসাগর কেন বিধবা বিবাহ প্রবর্তনে উদ্যোগী হয়েছিলেন? এ বিষয়ে তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান সম্পর্কে লেখো।
উত্তর: সমাজ সংস্কার আন্দোলনের দ্বারা সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। এই ঘোষণা বিধবা নারীকে বেঁচে থাকার অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছিল। তবে তা ছিল না-মরে বেঁচে থাকারই নামান্তর। তাদের সামাজিক নিরাপত্তা, শিক্ষার অধিকার বা মানবিক অধিকার কোনোটাই ছিল না। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নারীর এই দুরবস্থা দূর করতে উদ্যোগী হন। তিনি বিধবা বিবাহ আন্দোলন গড়ে তোলেন। পরাশর সংহিতা ও অন্যান্য হিন্দুশাস্ত্রের ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি প্রমাণ করেন যে বিধবা বিবাহ শাস্ত্রসম্মত। বিধবা বিবাহ আন্দোলনকে সমাজের সর্বস্তরে প্রসারিত করার উদ্দেশ্যে ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে বিদ্যাসাগর জনমত গঠনে প্রয়াসী হন। ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে বিধবা বিবাহ সম্পর্কিত দুটি গ্রন্থ রচনা করেন। এছাড়া সংবাদপত্রের মাধ্যমে বিধবা বিবাহের সপক্ষে নিজের বক্তব্যকে তুলে ধরেন। বিদ্যাসাগরের এই আন্তরিক প্রচেষ্টাকে সমর্থন জানিয়ে কলকাতার বিভিন্ন পত্রিকায় যুক্তিবাদী সমাজসংস্কারকদের প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। বিধবা বিবাহের সমর্থনকারীরা বিধবা বিবাহের পক্ষে আইন প্রণয়নের জন্য সরকারের কাছে জনস্বাক্ষরিত আবেদনপত্র জমা দেন। ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যাসাগর প্রায় হাজার জনের স্বাক্ষর সংগ্রহ করে সরকারের কাছে আবেদনপত্র পেশ করেন। নানা বিরোধিতা সত্ত্বেও ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জুলাই ইংরেজ সরকার পঞ্চদশ আইন পাস করে বিধবা বিবাহকে আইনসংগত বলে স্বীকৃতি প্রদান করে। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৭ই ডিসেম্বর বাংলার প্রথম বিধবা বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়। ১৮৫৬ থেকে ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিদ্যাসাগর নিজস্ব প্রচেষ্টায় ৫০টি বিধবা বিবাহের আয়োজন করেন। এতে তাঁর ৮২ হাজার টাকা খরচ হয়। বিদ্যাসাগর নিজের ছেলে নারায়ণচন্দ্রের সঙ্গে এক বিধবার বিবাহ দিয়েছিলেন।
জ. ‘স্বামী বিবেকানন্দের কাছে ধর্ম ছিল মানবসেবা ও দেশপ্রেমের ভিত্তি’—এই মন্তব্যের আলোকে বিবেকানন্দের ধর্মভাবনাকে ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: স্বামী বিবেকানন্দ ভারতের সনাতন ধর্মের বেদান্তের আদর্শকে বাস্তবে রূপদান করতে চেয়েছিলেন। তাঁর কাছে ধর্ম ছিল মানবসেবা ও দেশপ্রেমের ভিত্তি। তিনি বেদান্তের আদর্শ তথা ধর্মীয়তাত্ত্বিক বিচারের সঙ্গে দেশবাসী বাস্তব সমস্যাকে মিলিত করে নিজের চিন্তাধারা গঠন করেন। বেদান্তের আদর্শকে শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক পরিসরে আটকে না রেখে তাকে তিনি জাতি গঠনের এবং মানবসেবার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছিলেন। তাঁর মতে ধর্মচর্চা ব্যক্তিগত বিচ্ছিন্ন সাধন ভজন নয়, তা জাতির সার্বিক বিকাশের জন্য অপরিহার্য। তিনি বেদান্তের শাশ্বত আধ্যাত্মবাদ ও আদর্শবাদের সঙ্গে পাশ্চাত্যের যুক্তিবাদের সমন্বয় সাধন করে এক নতুন পথের সন্ধান দেন। প্রাচ্য ও প্রাশ্চাত্যের শ্রেষ্ঠ ভাবধারার সমন্বয়ে জাতি গঠনের ডাক দেন। বেদান্তের এই প্রায়োগিক দিক-ই নব্য বেদান্ত নামে পরিচিত। ভারতের দারিদ্র্য, অস্পৃশ্যতা, ধর্মীয় ভেদাভেদ, জাতিভেদ প্রভৃতি দূর করে তিনি নতুন ভারতবর্ষ গঠনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে মানুষকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। রামকৃষ্ণের ‘যত মত তত পথ’ আদর্শে বিশ্বাসী বিবেকানন্দ অখণ্ড মানবসত্তায় আস্থা রেখেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘ভাবী ভারত গঠনে ধর্মের ঐক্যসাধন অনিবার্যরূপে প্রয়োজন।’ বহু ধর্মে বিভক্ত ভারতবর্ষে ধর্মের সমন্বয়সাধনই হবে ভবিষ্যৎ ভারত গঠনের প্রাথমিক কর্মসূচি। ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে বিবেকানন্দ শিকাগো ধর্মসভায় বেদান্ত দর্শন, সমন্বয়বাদের সমর্থনে বক্তব্য রাখেন। ভারতে ফিরে নব্য বেদান্তের ভাবনাকে তিনি বাস্তবে রূপায়িত করেন। আধ্যাত্মিক উন্নতি ও সমাজসেবাকে আদর্শ করে তিনি ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে হাওড়া জেলার বেলুড়ে রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা করেন। অসহায় আর্ত পীড়িত মানুষের সেবার মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের সান্নিধ্যলাভের মহৎ আদর্শই এই প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য হয়ে ওঠে। বিবেকানন্দের আদর্শ জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষকে সর্বধর্ম সমন্বিত মানবতাবাদের উদার ছত্রচ্ছায়ায় একত্রিত হতে অনুপ্রাণিত করে। তিনি ভারতবাসীকে মানবপ্রেম ও স্বদেশপ্রেমে দীক্ষিত করেছিলেন। বিবেকানন্দের ‘Manmaking religion’-এর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে অরবিন্দ ঘোষ, সুভাষচন্দ্র বসু-সহ বাংলার অনেক স্বাধীনতা সংগ্রামী তাঁর ভাবশিষ্য হয়ে ওঠেন। তাঁরা বিবেকানন্দের আদর্শে চালিত হয়ে এক নতুন ভারতবর্ষ নির্মাণে উদ্যত হন।
ব্যাখ্যাধর্মী প্রশ্ন
ক. উনিশ শতকের সাময়িকপত্র, সংবাদপত্র, সাহিত্য প্রভৃতি ছিল তৎকালীন সমাজজীবনের আয়না-বিভিন্ন উদাহরণ সহযোগে মন্তব্যটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।
উত্তর: উনিশ শতকের বাংলা সাময়িক পত্রপত্রিকা, সংবাদপত্র এবং সাহিত্য রচনার মধ্য দিয়ে তৎকালীন সমাজকে বাংলার আপামর জনসাধারণের সামনে তুলে ধরা হয়েছিল। ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করার কাজেও এগুলি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। নীলচাষিদের দুঃখ-দুর্দশার কাহিনি, অত্যাচারী নীলকরদের প্রকৃত স্বরূপ, সন্ন্যাসী বিদ্রোহকালীন বাংলার চিত্র, জমিদার শ্রেণির অসংযত, বিলাসবৈভবপূর্ণ জীবনযাপনের কথা, সতীদাহ প্রথা রদ এবং বিধবা বিবাহ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে বাঙালির মনোভাব, নারীশিক্ষা এবং সমাজে নারীর অবস্থান—উনিশ শতকের সমাজ জীবনের এমন সব বিচিত্র ছবির কোলাজে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল সাময়িকপত্র, সংবাদপত্র এবং সাহিত্যের পাতা। আক্ষরিক অর্থেই এরা হয়ে উঠেছিল তৎকালীন সমাজজীবনের আয়না। এই প্রসঙ্গে রামনারায়ণ তর্করত্নের ‘কুলীনকুল সর্বস্ব’ (১৮৫৪ খ্রি.), মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ (১৮৬০ খ্রি.), ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ (১৮৬০ খ্রি.) প্রভৃতি নাটক, রামমোহন রায় সম্পাদিত ‘সম্বাদ কৌমুদী’ (১৮২১ খ্রি.), ভবানী চরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সমাচার চন্দ্রিকা’ (১৮২২ খ্রি.) ঈশ্বর গুপ্তের ‘সংবাদ প্রভাকর’ (১৮৩১ খ্রি.), প্যারীচাঁদ মিত্রের ‘আলালের ঘরে দুলাল’ (১৮৫৮ খ্রি.), ‘মদখাওয়া বড় দায়, জাত থাকবে কি উপায়’ (১৮৫৯ খ্রি.) প্রভৃতি আখ্যান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই সকল রচনা তৎকালীন সমাজের বাস্তব চিত্রকে প্রতিফলিত করেছিল, যা এই মাধ্যমগুলিকে সমাজের দর্পণে পরিণত করে।
খ. ইংরেজরা কেন ভারতবর্ষে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার ঘটাতে চেয়েছিলেন? ইংরেজি শিক্ষা প্রসারে সরকারি উদ্যোগ সম্পর্কে লেখো।
উত্তর: আঠারো শতকের শেষদিকে বিভিন্ন কারণে এদেশে ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তনের দাবি উঠতে থাকে। অনেক ইংরেজ প্রশাসক মনে করতেন শাসনকার্যের সুবিধার্থে ইংরেজি শিক্ষার প্রয়োজন। এদেশীয়রা ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হলে অল্প বেতনে তাদের প্রশাসনিক কাজে লাগানো যাবে। আবার কিছু উদার মানবতাবাদী ইংরেজ কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভারতবাসীর মুক্তির জন্য ও ভারতবাসীর সার্বিক উন্নতির জন্য ইংরেজি শিক্ষার প্রয়োজন উপলব্ধি করেছিলেন।
সরকারি উদ্যোগের ক্ষেত্রে, মেকলের প্রতিবেদন-এর ফলস্বরূপ শিক্ষাক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষার চর্চার বিষয়টি আরো গুরুত্ব লাভ করে। এরপর ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে গভর্নর জেনারেল লর্ড হার্ডিঞ্জ জানালেন, সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ইংরেজি জানা আবশ্যক। ইংরেজি ভাষায় দক্ষ মেধাবী ছাত্রদের সরকারের উচ্চপদে নিয়োগ করা হবে। ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশে কাউন্সিল অফ এডুকেশন গঠিত হয়। ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দের ১৯ জুলাই প্রকাশিত হয় চার্লস উডের প্রতিবেদন বা ‘উডস্ ডেসপ্যাচ’। এই প্রতিবেদন অনুসারে পাশ্চাত্য শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে ইংরেজির সাথে দেশীয় ভাষাকেও স্বীকৃতি দেওয়া হয়, তবে উচ্চশিক্ষার জন্য ইংরেজি ভাষা মাধ্যমকেই ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের মডেলে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় বিশ্ববিদ্যালয় গঠিত হয়। উচ্চ বিদ্যালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয় এবং সেখানে ইংরেজি ও মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়েরও সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
গ. উনিশ শতকে নারীশিক্ষা প্রসার ও নারীমুক্তি আন্দোলনের ক্ষেত্রে সমাজ সংস্কারকরা যে যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন সেগুলি সম্পর্কে আলোচনা করো।
উত্তর: উনিশ শতকে নারী শিক্ষা ও নারীমুক্তি আন্দোলনের সমর্থনে বেশ কিছু সাময়িকপত্র প্রকাশিত হয়, যার মধ্যে ‘বামাবোধিনী’ পত্রিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই পত্রিকাটি নারীর অধিকার ও নারী শিক্ষা সম্পর্কে সরব হয়ে ওঠে এবং নারীদের সাহিত্যরচনার জন্য উৎসাহিত করত। উৎকৃষ্ট লেখিকাকে পুরস্কৃত করারও ব্যবস্থা ছিল।
বাংলায় নারী শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনি প্রথম বাংলাদেশে হিন্দু নারী বিদ্যালয় স্থাপনে উদ্যোগী হন। শিক্ষা কাউন্সিলের তৎকালীন সভাপতি জে.ই.ডি বেথুনের ব্যক্তিগত পৃষ্ঠপোষকতায় এবং বিদ্যাসাগরের আন্তরিক প্রচেষ্টায় ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দের ৭ মে মেয়েদের জন্য বিদ্যালয় নির্মিত হয়, যা পরবর্তীকালে বেথুন স্কুল নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। বিদ্যালয় পরিদর্শক থাকাকালীন ১৮৫৭-৫৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বিদ্যাসাগর নদিয়া, বর্ধমান, হুগলি জেলায় সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগে এবং খরচায় ৩৫টি মেয়েদের স্কুল নির্মাণ করেন। পরবর্তীকালেও বিদ্যাসাগর বেশ কিছু মেয়েদের স্কুল তৈরি করেছিলেন এবং তাঁর সর্বশেষ প্রয়াস ছিল ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে নিজ গ্রাম বীরসিংহে ভগবতী বিদ্যালয় স্থাপন। বিদ্যাসাগরের বিশিষ্ট বন্ধু মদনমোহন তর্কালঙ্কার তাঁর দুই কন্যাকে বেথুন স্কুলে পড়তে পাঠিয়েছিলেন।
রাজা রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথা নিবারণে এবং পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারে উদ্যোগী হয়েছিলেন। ডেভিড হেয়ার ও জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বিটন বা বেথুন সাহেব এদেশে নারী শিক্ষা প্রসারে উদ্যোগী হয়ে ওঠেন। বেথুন ‘হিন্দু ফিমেল স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেন।
বিধবা বিবাহ আন্দোলন ছিল ভারতের নারীমুক্তি আন্দোলনের ক্ষেত্রে এক উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহ আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং প্রমাণ করেন যে বিধবা বিবাহ শাস্ত্রসম্মত। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জুলাই ইংরেজ সরকার পঞ্চদশ আইন পাস করে বিধবা বিবাহকে আইনসংগত বলে স্বীকৃতি প্রদান করে। এই আন্দোলনের পরিপূরক হিসাবে নারী শিক্ষার বিস্তার, নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা, বাল্য বিবাহ ও বহু বিবাহ রদ ইত্যাদি বিষয়গুলি উঠে আসে।
ঘ. “উনিশ শতকে উদার মানবতাবাদী কিছু ইংরেজ শিক্ষানুরাগী ভারতবর্ষের উন্নতির জন্য পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন”-তোমার জানা এমন দুজন শিক্ষানুরাগীর শিক্ষা প্রসারের উদ্যোগ সম্পর্কে আলোচনা করো।
উত্তর: উনিশ শতকে উদার মানবতাবাদী কিছু ইংরেজ শিক্ষানুরাগী কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভারতবর্ষের উন্নতির জন্য পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন। এদের মধ্যে ডেভিড হেয়ার ও জন এলিয়ট ড্রিঙ্ক ওয়াটার বিটন বা বেথুন সাহেবের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
ডেভিড হেয়ার: ডেভিড হেয়ার পেশায় ছিলেন একজন ঘড়ি ব্যবসায়ী। বেসরকারি উদ্যোগে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ডেভিড হেয়ারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় এবং তৎকালীন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি স্যার হাইড ইস্টের সহায়তায় ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু কলেজ স্থাপিত হয়। এছাড়া তিনি কলকাতা স্কুল বুক সোসাইটি পরিচালনায় মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। এই সোসাইটির উদ্যোগে অনেক নতুন বিদ্যালয় গড়ে ওঠে। ডেভিড হেয়ার কলকাতায় একটি ইংরেজি উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন বর্তমানে যা হেয়ার স্কুল নামে প্রসিদ্ধ। কলকাতায় মেডিক্যাল কলেজ স্থাপিত হলে ডেভিড হেয়ার সেখানে পরিচালক সংস্থার সচিব পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন।
জন এলিয়ট ড্রিঙ্ক ওয়াটার বিটন: জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বিটন বা বেথুন সাহেব ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে বড়োলাটের আইন সচিবের দায়িত্বভার গ্রহণ করে ভারতবর্ষে আসেন। সরকারের শিক্ষা পরিষদের সভাপতি পদে নিযুক্ত হয়ে তিনি এদেশে নারী শিক্ষা প্রসারে উদ্যোগী হয়ে ওঠেন। তাঁর এই উদ্যোগ বাস্তব রূপ লাভ করে ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে ৭ মে ‘হিন্দু ফিমেল স্কুল’ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। এই স্কুলটি পরবর্তীকালে বেথুন স্কুল নামে প্রসিদ্ধ হয়। নিজের যাবতীয় অস্থাবর সম্পত্তি তিনি বিদ্যালয়ের উন্নতিকল্পে দান করেছিলেন। তিনি কলকাতা পাবলিক লাইব্রেরি এবং বঙ্গ ভাষানুবাদক সমাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। নারীশিক্ষা প্রসারের জন্য তিনি গৌরমোহন বিদ্যালঙ্কার রচিত ‘স্ত্রী শিক্ষা-বিষয়ক’ গ্রন্থের একটি সংস্করণ প্রকাশ করে প্রচার করেছিলেন।
ঙ. নব্য বঙ্গগোষ্ঠীর সংস্কার আন্দোলন সম্পর্কে লেখো। এই আন্দোলন কেন সফল হয়নি বলে তোমার মনে হয়?
উত্তর: কলকাতার হিন্দু কলেজের তরুণ অধ্যাপক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও (১৮০৯-১৮৩১ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন উগ্র সংস্কারপন্থী গোষ্ঠীর প্রাণপুরুষ। ডিরোজিওর আদর্শে অনুপ্রাণিত হিন্দু কলেজের এই গোষ্ঠী ‘নব্যবঙ্গ গোষ্ঠী’ নামে পরিচিত হয়। ডিরোজিওর স্বাধীন চিন্তাধারা, যুক্তিবাদ, অসাধারণ পাণ্ডিত্য হিন্দু কলেজের ছাত্রদের স্বাধীন চিন্তায় উদ্বুদ্ধ করে। তিনি সামাজিক কুসংস্কার, বৈষম্য ও পরাধীনতার গ্লানি সম্পর্কে ছাত্রদের সচেতন করে তোলেন। তাঁর অনুগামীদের মধ্যে ছিলেন রামগোপাল ঘোষ, প্যারীচাঁদ মিত্র, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রামতনু লাহিড়ী, রাধানাথ সিকদার, শিবচন্দ্র দেব প্রমুখ। ডিরোজিওর অনুপ্রেরণায় ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে ‘অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন’ নামে একটি বিতর্কসভা গঠিত হয়। এখানে জাতিভেদ, কুসংস্কার, মূর্তিপূজা প্রভৃতির বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা হতে থাকে। নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর সদস্যরা বিভিন্ন সভাসমিতি, পত্রপত্রিকা ও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সমাজ সংস্কার, শিক্ষা, রাজনীতি প্রভৃতি বিষয়ে প্রচারকার্য চালিয়ে যান। তাঁরা ‘পার্থেনন’ নামে একটি সাপ্তাহিক ইংরেজি পত্রিকা প্রকাশ করেন এবং ‘জ্ঞানান্বেষণ’ পত্রিকা ও ‘সাধারণ জ্ঞানার্জন সমিতি’র মাধ্যমে হিন্দু সমাজের বহু বিবাহ, নারী শিক্ষা, বিধবা বিবাহ প্রভৃতি বিষয়ে নিজেদের স্বাধীন ও প্রগতিশীল ভাবনা তুলে ধরেন।
নব্যবঙ্গীয়দের সামাজিক পরিসর ছিল খুবই সংকীর্ণ। কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলেই তা সীমাবদ্ধ ছিল। কলকাতার কিছু শিক্ষিত তরুণ নানা বিষয়ে সমালোচনার ঝড় তুললেও তা বৃহত্তর সমাজ ও জনমানসে তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি। অন্যদিকে তাঁদের হিন্দু ধর্মের বিরুদ্ধে উগ্র প্রতিবাদ এবং পাশ্চাত্যের অনুকরণে যে বাড়াবাড়ি তা রক্ষণশীল সমাজ তথা সাধারণ মানুষও ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। দেশের বৃহত্তর সমাজে প্রবেশ করতে না পারায় নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর দ্বারা পরিচালিত সমাজ সংস্কার আন্দোলন কিছুদিনের মধ্যেই স্তিমিত হয়ে পড়ে।
চ. ব্রাহ্ম আন্দোলনের বিবর্তন ও বিভাজন সম্পর্কে লেখো।
উত্তর: ধর্ম তথা সমাজ সংস্কারের উদ্দেশ্যে ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে রামমোহন রায় ‘ব্রাহ্মসভা’ প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরবর্তীকালে ব্রাহ্ম সমাজ (১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে) হিসেবে প্রসিদ্ধ হয়। রামমোহন রায়ের মৃত্যুর পর মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্ম সমাজের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। দেবেন্দ্রনাথের উদ্যোগে ‘ব্রাহ্ম সমাজ’ ব্রাহ্ম ধর্ম নামে সাংগঠনিক রূপ লাভ করে এবং ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’ ও ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’র মধ্য দিয়ে ব্রাহ্ম আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করেন।
পরবর্তীকালে কেশবচন্দ্র সেনের নেতৃত্বে ব্রাহ্ম আন্দোলনের গতি ত্বরান্বিত হয়। তিনি ব্রাহ্ম আন্দোলনকে সামাজিক আদর্শ ও ধর্মবিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে কেশবচন্দ্র সেন ব্রাহ্ম সমাজের আচার্য পদে অধিষ্ঠিত হন। এই সময়কার ব্রাহ্ম আন্দোলনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল একে সমাজ সংস্কার আন্দোলনের প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা। কেশবচন্দ্রের নেতৃত্বে বাল্য বিবাহ, বহু বিবাহ, জাতিভেদ প্রথা প্রভৃতির বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত হয়। নারীশিক্ষা প্রসার, অসবর্ণ বিবাহ, বিধবা বিবাহ, শ্রমিক কল্যাণ প্রভৃতি প্রগতিশীল সংস্কারমূলক কার্যকলাপ শুরু হয়।
দেবেন্দ্রনাথ ও তাঁর অনুগামীদের সাথে কেশবচন্দ্রের মতবিরোধ দেখা দেয় কারণ তরুণ ব্রাহ্মরা উপবীত ধারণে বিশ্বাসী ছিলেন না, মহিলাদের যোগদানের পক্ষপাতী ছিলেন এবং অসবর্ণ বিবাহের প্রতি সমর্থন ছিল। ১৮৬৬-তে কেশবচন্দ্র ও তাঁর অনুগামীরা ‘ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্ম সমাজ’ গঠন করেন। মূল ব্রাহ্ম সমাজ ‘আদি ব্রাহ্ম সমাজ’ নামে পরিচিত হয়।
ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্ম সমাজে ব্রাহ্মধর্মকে সর্বজনীন হিসাবে তুলে ধরা হয়। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে অবাধ প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়। জনকল্যাণ, সমাজ সংস্কার ও জনগণের নৈতিক উন্নতিসাধন এই প্রতিষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য ছিল। নারীশিক্ষা উন্নয়নে ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে ভিক্টোরিয়া কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে সরকার ‘তিন আইন’ পাস করে, যাতে বাল্য বিবাহ ও বহু বিবাহকে নিষিদ্ধ করা হয় এবং বিধবা বিবাহ ও অসবর্ণ বিবাহ আইনসিদ্ধ হয়।
কেশচন্দ্রের মনে ক্রমশ আধ্যাত্মিক ভক্তিভাবের আধিক্য ঘটে এবং তিনি গুরুবাদের প্রতি আকৃষ্ট হন। এই সময় বিক্ষুব্ধ প্রগতিশীল তরুণ শিবনাথ শাস্ত্রী, আনন্দমোহন বসু, দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়, বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী প্রমুখরা ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন ‘সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ’। কেশবচন্দ্র পরিচালিত ব্রাহ্ম সমাজ ‘নববিধান’ নামে পরিচিত হয়। এইভাবে ব্রাহ্ম সমাজ আদি ব্রাহ্ম সমাজ, নববিধান ও সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ- এই তিনটি পৃথক গোষ্ঠীতে ভাগ হয়ে যায়। অভ্যন্তরীণ বিভেদের ফলে ব্রাহ্ম সমাজের শক্তি ক্রমশ শিথিল হয়ে পড়ে।
ছ. বাংলার নবজাগরণের চরিত্র সম্পর্কে আলোচনা করো।
উত্তর: উনিশ শতকে বাঙালির চিন্তাজগতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত হয়। এই পরিবর্তনের মূলে ছিল যুক্তিবাদী ও মানবতাবাদী পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার। বাঙালির চিন্তাজগতের পরিবর্তন ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনেও ছাপ ফেলে। ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনের চিরাচরিত কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাসের স্থানে দেখা দেয় যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞান চেতনা। শুধুমাত্র ধর্ম বা সমাজ নয় শিক্ষা, সাহিত্য, দর্শন, রাজনীতি—সর্বত্র পরিলক্ষিত হয় আধুনিক যুক্তিবাদী মনস্কতা।
বাংলার নবজাগরণকে অনেক ঐতিহাসিক ইতালির নবজাগরণ বা রেনেসাঁসের সঙ্গে তুলনা করে ‘বঙ্গীয় নবজাগরণ’ বলে অভিহিত করেছেন। ইতালির রেনেসাঁস যেমন ইউরোপকে অন্ধবিশ্বাস, মধ্যযুগীয় তন্দ্রা থেকে মুক্ত করে তেমন বাংলার নবজাগরণ মধ্যযুগীয় কুসংস্কার থেকে ভারতবর্ষকে মুক্তির সন্ধান দেয়। ইতালির রেনেসাঁসে যে স্বাধীন, যুক্তিবাদী মানসিকতা দেখা যায়, বাংলার ডিরোজিও ও নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীদের আন্দোলনেও সেই যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়। রামমোহন, বিদ্যাসাগর প্রমুখদের সমাজ সংস্কার আন্দোলনে ইতালীয় রেনেসাঁসের মানবতাবাদের প্রভাব বিকাশ লাভ করে।
বাংলার নবজাগরণের দুটি পৃথক সমন্বয় দেখতে পাওয়া যায়: পাশ্চাত্যের উদারপন্থী ভাবধারা এবং পুনরুজ্জীবনবাদী প্রাচ্যবাদ। প্রথম ধারার প্রভাবে সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কার ও নারী আন্দোলন গড়ে ওঠে। দ্বিতীয় ধারা অনুযায়ী, সরকারি আইন প্রয়োগ করে প্রচলিত সংস্কার রদ করার চেষ্টা ভুল নীতি। এই দুই ধারার অভিঘাতে এক তৃতীয় ধারার উদ্ভব হয়, যাকে সমন্বয়বাদী ধারা বলা যায়। প্রাচীন যুগের শ্রেষ্ঠত্বের সঙ্গে পশ্চিমের জ্ঞান-বিজ্ঞানকে মিলিয়ে এক সমন্বিত পথ তৈরি করা হয়। বাংলার নবজাগরণ এই সমন্বিত পথে এগিয়ে চলে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের শ্রেষ্ঠ ভাবধারার মিলনে গঠিত এই সমন্বিত ভাবধারাই ছিল বাংলা নবজাগরণের ভিত্তি। এই সমন্বয়বাদের প্রবক্তা ছিলেন রাজা রামমোহন রায়, বঙ্কিমচন্দ্র, স্বামী বিবেকানন্দ, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ প্রমুখরা।
তবে উনিশ শতকের নবজাগরণে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। বাংলার এই নবজাগরণের সঙ্গে শ্রমিক-কৃষক বা গ্রামীণ মানুষের কোনো সম্পর্ক ছিল না। এই নবজাগরণে যাঁরা শামিল হয়েছিলেন তাঁরা ছিলেন ‘মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক’। এই নবজাগরণ মুসলিম সম্প্রদায়কে আকর্ষণ করতে পারেনি এবং হিন্দু সমাজের মধ্যেই মূলত তা সীমাবদ্ধ ছিল। এছাড়া নবজাগরণের নেতারা কোম্পানির সাম্রাজ্যবাদী শোষণ সম্পর্কে উদাসীন ছিলেন।
জ. বঙ্গীয় নবজাগরণকে ইতালীয় রেনেসাঁসের সঙ্গে তুলনা করা যায় কিনা—এ বিষয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে তার প্রতি আলোকপাত করো।
উত্তর: উনিশ শতকের বাংলার জাগরণকে অনেক ঐতিহাসিক ইতালির নবজাগরণ বা রেনেসাঁসের সঙ্গে তুলনা করে ‘বঙ্গীয় নবজাগরণ’ বলে অভিহিত করেছেন। যদুনাথ সরকার তাঁর ‘History of Bengal’ গ্রন্থে দ্বিধাহীনভাবে বাংলার জাগরণকে ‘নবজাগরণ’ বা রেনেসাঁস বলে ব্যাখ্যা করেছেন। অধ্যাপক সুশোভন সরকার তাঁর ‘Note of Bengal Renaissance’ গ্রন্থে বাংলার নবজাগরণের সঙ্গে ইতালীয় রেনেসাঁকে তুলনা করেছেন। ডঃ অম্লান দত্তও নবজাগরণের নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও তার ‘অসামান্যতা’ স্বীকার করেছেন। ঐতিহাসিকরা ইতালীয় রেনেসাঁসের সঙ্গে বাংলার নবজাগরণের সাদৃশ্য লক্ষ করেন এই ভিত্তিতে যে, উভয়ই ইউরোপ/ভারতবর্ষকে অন্ধবিশ্বাস ও মধ্যযুগীয় তন্দ্রা থেকে মুক্ত করে যুক্তিবাদী মানসিকতা ও মানবতাবাদের বিকাশ ঘটায়।
তবে এক শ্রেণির সমালোচক এই তুলনার তীব্র সমালোচনা করেছেন। তাঁদের মতে বঙ্গীয় নবজাগরণ কখনই ইতালীয় রেনেসাঁসের সমতুল্য নয়। ড. অমলেশ ত্রিপাঠীর মতে বাংলার নবজাগরণের প্রেক্ষাপট ও প্রকৃতির সঙ্গে ইতালীয় নবজাগরণের অনেক পার্থক্য ছিল। ইতালীয় নবজাগরণ ঘটেছিল স্বাধীন ও মুক্ত পরিবেশে, কিন্তু বাংলার নবজাগরণের কেন্দ্র কলকাতা ছিল ব্রিটিশ শাসনাধীন। কলকাতা ছিল বাণিজ্যের শহর, শিল্পের শহর নয়, তাই ইতালির ফ্লোরেন্স নগরীর মতো কলকাতা শিল্পীদের লালন করতে পারেনি। বাংলার নবজাগরণের পথিকৃৎরা ছিলেন বেশিরভাগ জমিদার বা সরকারি কর্মচারী, যাঁদের মধ্যে ফ্লোরেন্সের বুর্জোয়া শ্রেণির সাদৃশ্য খোঁজা নিষ্ফল। ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কার ছাড়া আর কোনো শিল্প-সাহিত্যকর্মের উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ তাঁরা গ্রহণ করতে পারেননি। ইতালীয় নবজাগরণের প্রেরণা ছিল গ্রিক ও ল্যাটিন সাহিত্য, কিন্তু বঙ্গীয় নবজাগরণের প্রেরণা আসে মূলত ইংরেজি সাহিত্য থেকে। শেকসপিয়র, মিলটন, বায়ন, বেকন, মিল প্রমুখরা বাংলার নবজাগরণকে সমৃদ্ধ করেন। ঋষি অরবিন্দর মতে ভারতের মাটিতে ইওরোপীয় ধাঁচের রেনেসাঁসের জন্ম সম্ভব নয়। ড. সুমিত সরকার বলেছেন-সমগ্র বাংলার জাগরণ ইংরেজের নকলনবিশ ছাড়া আর কিছু নয়। এই নবজাগরণ মূলত হিন্দু সমাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল এবং মুসলিম সম্প্রদায়কে আকর্ষণ করতে পারেনি।
এই বিতর্ক প্রমাণ করে যে, বঙ্গীয় নবজাগরণকে ইতালীয় রেনেসাঁসের সঙ্গে তুলনা করা একটি সরল বিষয় নয় এবং এর চরিত্র ও প্রেক্ষাপট স্বতন্ত্র ছিল।
অতিরিক্ত (Extras)
বহুনির্বাচনী প্রশ্ন (MCQs)
১. ইংরেজ শাসনের প্রবর্তিত কোন নীতিব্যবস্থা বাংলার মানুষের জীবনে বিপর্যয়ের ঝড় তোলে?
ক. ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা
খ. আইন ও বিচার
গ. শিক্ষা ব্যবস্থা
ঘ. কর ব্যবস্থা
উত্তর: ক. ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা
৫০. নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর সদস্য ডিরোজিওর উদ্যোগে কোন বিতর্কসভা গঠিত হয়?
ক. ‘আত্মীয় সভা’
খ. ‘অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন’
গ. ‘সম্বাদ কৌমুদী’
ঘ. ‘ব্রাহ্মসভা’
উত্তর: খ. ‘অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন’
প্রশ্ন ও উত্তর (Questions, Answers)
1. ‘বামাবোধিনী’ পত্রিকা কখন প্রকাশিত হয়েছিল?
উত্তর: ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে ‘বামাবোধিনী’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল।
36. ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহের প্রচলনে কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন তা আলোচনা করো।
উত্তর: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নারীর দুরবস্থা দূর করতে উদ্যোগী হয়ে বিধবা বিবাহ আন্দোলন গড়ে তোলেন। তিনি পরাশর সংহিতা ও অন্যান্য হিন্দুশাস্ত্রের ব্যাখ্যা দিয়ে প্রমাণ করেন যে বিধবা বিবাহ শাস্ত্রসম্মত। বিধবা বিবাহ আন্দোলনকে সমাজের সর্বস্তরে প্রসারিত করার উদ্দেশ্যে তিনি ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে জনমত গঠনে প্রয়াসী হন। ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি বিধবা বিবাহ সম্পর্কিত দুটি গ্রন্থ রচনা করেন এবং সংবাদপত্রের মাধ্যমেও বিধবা বিবাহের সপক্ষে নিজের বক্তব্য তুলে ধরেন। তাঁর এই আন্তরিক প্রচেষ্টাকে সমর্থন জানিয়ে কলকাতার বিভিন্ন পত্রিকায় যুক্তিবাদী সমাজসংস্কারকদের প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। বিধবা বিবাহের সমর্থনকারীরা সরকারের কাছে আইন প্রণয়নের জন্য জনস্বাক্ষরিত আবেদনপত্র জমা দেন এবং ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যাসাগর নিজে প্রায় হাজার জনের স্বাক্ষর সংগ্রহ করে সরকারের কাছে আবেদনপত্র পেশ করেন। বিদ্যাসাগর নিজের ছেলে নারায়ণচন্দ্রের সঙ্গেও এক বিধবার বিবাহ দিয়েছিলেন। ১৮৫৬ থেকে ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি নিজস্ব প্রচেষ্টায় ৫০টি বিধবা বিবাহের আয়োজন করেন, যাতে তাঁর ৮২ হাজার টাকা খরচ হয়। এই সমস্ত প্রচেষ্টার ফলে এবং নানা বিরোধিতা সত্ত্বেও ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জুলাই ইংরেজ সরকার পঞ্চদশ আইন পাস করে বিধবা বিবাহকে আইনসংগত বলে স্বীকৃতি প্রদান করে এবং ওই বছর ৭ই ডিসেম্বর বাংলার প্রথম বিধবা বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়।
Get notes of other boards, classes, and subjects