এখানে (chapter 3) প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ: WBBSE ক্লাস 10 ইতিহাস (History) (Bengali medium) আধুনিক ভারতের ইতিহাস ও পরিবেশ (Adhunik Bharater Itihas O Poribesh)-এর উত্তর, ব্যাখ্যা, সমাধান, নোট, অতিরিক্ত তথ্য, এমসিকিউ এবং পিডিএফ পাওয়া যাবে। নোটগুলো শুধুমাত্র রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করুন এবং প্রয়োজনমতো পরিবর্তন করতে ভুলবেন না।
Select medium |
English medium notes |
Bengali medium notes |
সারাংশ (summary)
এই অধ্যায়ের নাম প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ : বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ (Pratirodh o Bidroho: Boishishto o Bishleshon)। ব্রিটিশরা যখন ভারত শাসন করত, তখন অনেক মানুষ, বিশেষ করে যারা বনে বা গ্রামে থাকত, তারা খুব কষ্টে পড়েছিল। আদিবাসী মানুষেরা বনে কাঠ ও ফলমূল সংগ্রহ করে আর শিকার করে থাকত। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার ‘অরণ্য আইন’ নামে নতুন নিয়ম আনে। এই নিয়মের ফলে আদিবাসীরা আগের মতো বন ব্যবহার করতে পারত না, তাদের চাষের জমিও কেড়ে নেওয়া হয়। ব্রিটিশরা বন থেকে জিনিস বিদেশে পাঠাত। এছাড়া, ব্রিটিশরা জমি নিয়ে নতুন নিয়ম চালু করে, যাতে মহাজন ও জমিদাররা আদিবাসীদের ঠকাতে শুরু করে। এইসব কারণে আদিবাসীরা খুব রেগে যায় এবং নিজেদের বাঁচানোর জন্য লড়াই শুরু করে। চুয়াড়, কোল, মুন্ডা, সাঁওতাল নামের বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠী দেশের নানা জায়গায় বিদ্রোহ করে। এই বিদ্রোহগুলো প্রথমে ছোট থাকলেও পরে বড় লড়াইয়ের রূপ নেয়। যদিও ব্রিটিশদের সৈন্য অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল, তাই তারা এই বিদ্রোহগুলো দমন করতে পেরেছিল। কিন্তু এই আদিবাসীরাই প্রথম ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল।
এরকম আরও কিছু বিদ্রোহ হয়েছিল। যেমন চুয়াড় বিদ্রোহ (১৭৯৮-১৭৯৯), যেখানে মেদিনীপুর, বাঁকুড়া অঞ্চলের আদিবাসীরা জমি হারানোর জন্য বিদ্রোহ করে। কোল বিদ্রোহে (১৮৩১-১৮৩২) ছোটনাগপুরের কোলরা নতুন জমি ও বিচার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়েছিল। সাঁওতাল বিদ্রোহ বা ‘হুল’ (১৮৫৫-১৮৫৬) ছিল খুব বড় একটা লড়াই। সিধু ও কানুর নেতৃত্বে সাঁওতালরা জমিদার, মহাজন ও ব্রিটিশদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। তারা ‘দামিন-ই-কোহ’ নামে নিজেদের এলাকা তৈরি করেছিল। বিরসা মুন্ডার নেতৃত্বে মুন্ডা বিদ্রোহ (১৮৯৯-১৯০০) হয়েছিল, যেখানে মুন্ডারা তাদের জমি ও পুরনো নিয়ম বাঁচানোর জন্য লড়েছিল। বিরসা মুন্ডা নিজেকে ভগবানের দূত বলতেন এবং लोकांना সাহস জুগিয়েছিলেন।
এছাড়া সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ (১৭৬৩-১৮০০) হয়েছিল, যেখানে প্রথমে সন্ন্যাসী ও ফকিররা, পরে কৃষকরাও যোগ দেয়। তারা ব্রিটিশদের কর ও নিয়ম মানতে চায়নি। বাংলায় তিতুমীরের নেতৃত্বে ওয়াহাবি আন্দোলন হয়েছিল। তিতুমীর প্রথমে ধর্ম নিয়ে কথা বললেও পরে জমিদার ও নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়েন। তিনি নারকেলবেড়িয়ায় একটি বিখ্যাত ‘বাঁশের কেল্লা’ বানিয়েছিলেন, যা ব্রিটিশরা ভেঙে দেয়। ফরাজি আন্দোলন শুরু করেন হাজি শরিয়তউল্লাহ, পরে তার ছেলে দুদু মিয়াঁ এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যান। তারাও গরিব কৃষক ও তাঁতিদের জন্য লড়েছিলেন।
সবশেষে, নীল বিদ্রোহের (১৮৫৯-১৮৬০) কথা বলা হয়েছে। ব্রিটিশ নীলকর সাহেবরা চাষিদের জোর করে নীল চাষ করতে বাধ্য করত, কিন্তু তার দাম দিত না এবং খুব অত্যাচার করত। বাংলার চাষিরা এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় এবং ঠিক করে যে তারা আর নীল চাষ করবে না। এই বিদ্রোহে অনেক সাধারণ মানুষ, এমনকি কিছু জমিদার ও শিক্ষিত বাঙালিরাও চাষিদের সমর্থন করেছিল। এর ফলে সরকার একটি কমিশন বসায় এবং শেষ পর্যন্ত জোর করে নীল চাষ বন্ধ হয়। এই সব বিদ্রোহ দেখিয়েছিল যে ভারতের সাধারণ মানুষ অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে ভয় পায়নি।
পাঠ্য প্রশ্ন ও উত্তর (Prantik textbook)
সঠিক উত্তরটি নির্বাচন করো
ক) ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিংভূম সীমান্তে প্রতিরোধ গড়ে তোলে
(i) কোল জাতি
(ii) ভিল জাতি
(iii) মুন্ডা জাতি
(iv) সাঁওতাল জাতি
উত্তর: (i) কোল জাতি
খ) ‘দিকু’ শব্দের অর্থ হল-
(i) অপরিচিত
(ii) দেশি
(iii) বিদেশি
(iv) এক অঞ্চলের মানুষ
উত্তর: (iii) বিদেশি
গ) ফরাজি আন্দোলনের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল-
(i) ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা
(ii) ইসলাম ধর্মের সংস্কার সাধন
(iii) সমাজ সংস্কার সাধন
(iv) কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলা
উত্তর: (ii) ইসলাম ধর্মের সংস্কার সাধন
ঘ) বাংলায় নীল চাষ শুরু হওয়ার কারণ ছিল-
(i) ইউরোপে নীলের বর্ধিত চাহিদা
(ii) বাংলায় নীল চাষে মুনাফা
(iii) পূর্বোক্ত দুটি কারণেই
(iv) এদের মধ্যে কোনোটিই নয়।
উত্তর: (iii) পূর্বোক্ত দুটি কারণেই
ঙ) সুই মুন্ডা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন-
(i) চুয়াড় বিদ্রোহ
(ii) কোল বিদ্রোহ
(iii) সাঁওতাল বিদ্রোহ
(iv) মুন্ডা বিদ্রোহ
উত্তর: (ii) কোল বিদ্রোহ
নীচের বিবৃতি গুলির মধ্যে কোনটি ঠিক কোটি ভুল লেখো
(ক) ‘হুল’ ছিল মুন্ডা বিদ্রোহীদের সংগঠন।
উত্তর: ভুল
কারণ: ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে সাঁওতালরা বিদেশি বা দিকুদের বিতাড়িত করার জন্য ‘হুল’ নামে সংগঠন গঠন করেছিল।
(খ) ওয়াহাবি শব্দের অর্থ নবজাগরণ।
উত্তর: ঠিক
কারণ: ‘ওয়াহাবি’ শব্দের অর্থ ‘নবজাগরণ’।
(গ) দুদুমিয়াঁর প্রকৃত নাম হাজি-শরিয়ৎ-উল্লাহ।
উত্তর: ভুল
কারণ: হাজি শরিয়ত উল্লাহর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র মহম্মদ মহসিন ওরফে দুদুমিয়াঁ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। সুতরাং, দুদুমিয়াঁ ছিলেন হাজি শরিয়ত উল্লাহর পুত্র, তাঁর আসল নাম ছিল মহম্মদ মহসিন।
(ঘ) নীলচাষের ভিত্তি ছিল ভূমিদাসত্ব ও বেগার শ্রমদান।
উত্তর: ঠিক
কারণ: নীলচাষের ভিত্তি ছিল ভূমিদাসত্ব ও বেগার শ্রম।
প্রদত্ত ভারতবর্ষের মানচিত্রেনিম্নলিখিত স্থানগুলি চিহ্নিত করো
(ক) নীল-বিদ্রোহের কেন্দ্র বারাসত
(খ) রংপুর বিদ্রোহের এলাকা রংপুর
(গ) পাবনার কৃষক বিদ্রোহের এলাকা
(ঘ) সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের এলাকা, মুরশিদাবাদ।
উত্তর:
বামস্তম্ভের সঙ্গে ডানস্তম্ভ মেলাও :
বামস্তম্ভ | ডানস্তম্ভ |
(i) ফরজ | (a) চুয়াড় বিদ্রোহ |
(ii) দার-উল-ইসলাম | (b) সাঁওতাল বিদ্রোহ |
(iii) গোবর্ধন দিকপতি | (c) আল্লাহর আদেশ |
(iv) ভাগনাডিহির মাঠ | (d) ধর্মরাজ্য |
উত্তর:
প্রশ্ন | উত্তর |
(i) ফরজ | (c) আল্লাহর আদেশ |
(ii) দার-উল-ইসলাম | (d) ধর্মরাজ্য |
(iii) গোবর্ধন দিকপতি | (a) চুয়াড় বিদ্রোহ |
(iv) ভাগনাডিহির মাঠ | (b) সাঁওতাল বিদ্রোহ |
একটি বাক্যে উত্তর দাও
ক. কোল বিদ্রোহের দুজন নেতার নাম লেখো।
উত্তর: কোল বিদ্রোহের দুজন নেতা ছিলেন বুদ্ধ ভগৎ ও জোয়া ভগৎ।
খ. সাঁওতাল বিদ্রোহে আর কোন্ কোন্ উপজাতিরা যোগদান করেছিল?
উত্তর: সাঁওতালদের সংগ্রামে অনুপ্রাণিত হয়ে মাল ও ভুয়ান উপজাতিরা সাঁওতাল বিদ্রোহে যোগদান করেছিল।
গ. হাজি-শরিয়ৎ-উল্লাহর মৃত্যুর পর কে ফরাজি আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন?
উত্তর: হাজি-শরিয়ৎ-উল্লাহর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র মহম্মদ মহসিন ওরফে দুদুমিয়াঁ ফরাজি আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
ঘ. কার লেখা কোন্ উপন্যাসে সন্ন্যাসী বিদ্রোহের ছবি ফুটে উঠেছে?
উত্তর: বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে সন্ন্যাসী বিদ্রোহের ছবি ফুটে উঠেছে।
ঙ. কোন্ আইন প্রণয়নের দ্বারা ভারতে সমগ্র ব্রিটেনের জন্য নীলচাষের অবাধ ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছিল?
উত্তর: ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দের সনদ আইন প্রণয়নের দ্বারা ভারতে সমগ্র ব্রিটেনের জন্য নীলচাষের অবাধ ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছিল।
চ. কে প্রথম বাংলায় নীল চাষ শুরু করেছিলেন?
উত্তর: লুই বন্নো নামে এক ফরাসি প্রথম বাংলায় নীলের চাষ শুরু করেন।
ছ. ওয়াহাবি শব্দের অর্থ কী?
উত্তর: ‘ওয়াহাবি’ শব্দের অর্থ ‘নবজাগরণ’।
সংক্ষিপ্ত উত্তরধর্মী প্রশ্ন
ক. উনিশ শতকের উপজাতি বিদ্রোহের মূল কারণ কী ছিল বলে তোমার মনে হয়?
উত্তর: উনিশ শতকে অরণ্য আইন প্রবর্তন এবং ঔপনিবেশিক অত্যাচারে আদিবাসীদের জীবন চরম দুর্দশার সম্মুখীন হয়। নতুন ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থার প্রবর্তন ও নতুন ভূমিবণ্টন ব্যবস্থায় মহাজন, ঠিকাদার, দালালদের অনুপ্রবেশ আদিবাসী সমাজকে ক্ষিপ্ত করে তোলে। আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে ব্রিটিশ পুলিশ ও বিচারব্যবস্থা স্থাপিত হলে তা আদিবাসীদের প্রচলিত জীবনধারায় আঘাত হানে। এইসব কারণে আদিবাসীরা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
খ. চুয়াড় বিদ্রোহকে দমন করার উদ্দেশ্যে ইংরেজ শক্তি কী ধরনের ভেদনীতি গ্রহণ করেছিল?
উত্তর: চুয়াড় বিদ্রোহ দমনে ইংরেজ সরকার ভেদনীতির আশ্রয় নিয়েছিল। চুয়াড়দের একাংশকে সরকারি কাজে নিযুক্ত করে, পাইকদের নিষ্কর জমি ফেরত দিয়ে, এবং কিছু অংশকে পুলিশের কাজে নিযুক্ত করে সরকার বিদ্রোহীদের ঐক্যে ফাটল ধরায়। পাইকদের দেয় রাজস্বের হার অনেক কমিয়েও দেওয়া হয় এবং প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় যে, পাইকদের জমি খাস দখল করা যাবে না বা জমিদারদের রাজস্ব বাকি থাকলেও নিলাম করা যাবে না।
গ. সাঁওতালদের ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে কী ধরনের আধ্যাত্মিক কাহিনি বা জনশ্রুতি প্রচারিত হয়েছিল?
উত্তর: সাঁওতাল জাতিকে সংগঠিত ও বিদ্রোহে অনুপ্রানিত করার উদ্দেশ্যে তাদের ধর্মীয়ভাবনাকে কাজে লাগনো হয়। সিধু কানু ঘোষণা করেন সাঁওতালদের ঠাকুর তাদের নির্দেশ দিয়েছেন যে সমস্ত সাঁওতালকে শত্রুদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে শামিল হতে হবে। সাঁওতাল পুরাণ, লোকগাথা ও সৃষ্টি তত্ত্বে ব্যবহৃত ভাষা ও প্রতীক ব্যবহার করে সাঁওতালদের ঐক্যবদ্ধ করা হয়।
ঘ. মুন্ডা বিদ্রোহের প্রধান নেতার নাম কী? তিনি মুন্ডাজাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য কী ঘোষণা করেছিলেন?
উত্তর: মুন্ডা বিদ্রোহের প্রধান নেতার নাম ছিল বিরসা মুন্ডা। তিনি মুণ্ডা চাষিদের ধর্মীয়ভাবে উদ্দীপিত করে সংঘবদ্ধ করেন এবং ঘোষণা করেন তিনি ঈশ্বরের দূত ও মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দূর করার অলৌলিক ক্ষমতা তার রয়েছে।
ঙ. ফরাজি আন্দোলনের নাম ‘ফরাজি’ হয় কেন?
উত্তর: ‘ফরজ’ শব্দের অর্থ হল আল্লাহর আদেশ। ফরাজি আন্দোলনের দ্বারা কোরানের নির্দেশ অনুযায়ী পাঁচটি অবশ্য পালনীয় কর্তব্য মুসলিমদের ফর্জ বা ফরইজ হিসাবে গ্রহণের জন্য অনুপ্রাণিত করা হয়। এই পাঁচটি কর্তব্য হল কলমা, নামাজ, রোজা, জ্যাকাৎ ও হজ। এর থেকেই আন্দোলনের নাম হয় ফরাজি।
চ. ভারতবর্ষে কোম্পানির উদ্যোগে নীল চাষ শুরু হয়েছিল কেন?
উত্তর: শিল্প বিপ্লবের ফলে ইউরোপে বস্ত্রবয়ন শিল্পে উন্নতি হওয়ায় সুতিবস্ত্রের চাহিদা ক্রমশ বৃদ্ধি পায় এবং এর সঙ্গে নীলের প্রয়োজনও উপলব্ধ হতে থাকে। এই বর্ধিত চাহিদা পূরণ করতে বাংলা থেকে নীল ইউরোপের বাজারে রফতানি শুরু হয়। ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরা নীল উৎপাদনের মুনাফা সম্পর্কে সজাগ হয়ে ওঠে এবং কোম্পানি এই লাভজনক ব্যবসার প্রসারের জন্য পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ থেকে ইউরোপীয় নীলকরদের ভারতে এনে নীল চাষে উৎসাহদান করে।
বিশ্লেষণধর্মী প্রশ্ন
ক. ইংরেজ সরকার প্রবর্তিত অরণ্য আইন আদিবাসীদের জীবনকে কীভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে?
উত্তর: অরণ্য আইনের ফলে আদিবাসীদের শান্ত জীবন অশান্ত হয়ে ওঠে। এই আইনের দ্বারা আদিবাসীদের ঝুমচাষ নিষিদ্ধ হয়। অরণ্য সম্পদের ওপর একচেটিয়া অধিকার স্থাপনের উদ্দেশ্যে সরকার আদিবাসীদের কাঠ সংগ্রহ ও গোচারণের অধিকারকেও নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে। ইংরেজরা বনজ সম্পদ বিদেশে রপ্তানি শুরু করলে আদিবাসীদের জীবন ক্রমেই ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে এবং সমস্ত বনাঞ্চলকে জবর দখল করে খাস ঘোষণা করা হয়। যাবতীয় বনসম্পদের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আদিবাসীদের মনে গভীর অসন্তোষের সৃষ্টি করে। এছাড়া, আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে ব্রিটিশ পুলিশ ও বিচারব্যবস্থা স্থাপিত হলে তা আদিবাসীদের প্রচলিত জীবনধারায় আঘাত হানে। অরণ্য আইন প্রবর্তন এবং ঔপনিবেশিক অত্যাচারে আদিবাসীদের জীবন চরম দুর্দশার সম্মুখীন হয়।
খ. চুয়াড় বিদ্রোহ সংগঠিত হওয়ার পিছনে কী কী কারণ ছিল বলে তোমার মনে হয়?
উত্তর: চুয়াড় বিদ্রোহ সংগঠিত হওয়ার পিছনে কারণগুলি ছিল:
(i) দেওয়ানি লাভের পর ইংরেজদের প্রধান লক্ষ্য ছিল সর্বাধিক রাজস্ব আদায় করে কোশাগার ভরতি করা। এই উদ্দেশ্য পূরণের জন্য ইংরেজরা জঙ্গলমহলে জমির নতুন বন্দোবস্তের মাধ্যমে জমিদারদের সঙ্গে স্থায়ী ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থার প্রবর্তন করে, এবং জমিদাররা প্রজাদের ওপর উচ্চহারে রাজস্ব ধার্য করেছিল। মেদিনীপুরের তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেটও স্বীকার করেছিলেন যে, চুয়াড়দের জমি থেকে উচ্ছেদ এবং রাজস্বের উচ্চহার হল চুয়াড় বিদ্রোহের প্রধান কারণ।
(ii) ইজারাদার ও জমিদাররা পুরোনো প্রজা উচ্ছেদ করে উচ্চ রাজস্ব হারে নতুন প্রজা বসায়, ফলস্বরূপ চুয়াড়রা জমিজমা, গৃহ, অরণ্য সব হারিয়ে ভয়ংকর বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়।
(iii) চুয়াড়দের মধ্যে একাংশ যারা জমিদারের পাইক হিসাবে নিষ্কর জমি ভোগ করত, নতুন ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থায় তারাও নিষ্কর জমি হারায়।
গ. ইংরেজদের সামরিক আইন ও উন্নত অস্ত্রের কাছে সাঁওতালরা পরাজয় স্বীকার করে নেয়-তোমার কী মনে হয় যে এই পরাজয়ে সাঁওতাল বিদ্রোহ সম্পূর্ণরূপেই ব্যর্থ হয়েছিল? তোমার উত্তরের সপক্ষে যুক্তি দাও।
উত্তর: যদিও সংগ্রামী সাঁওতাল কৃষকদের রক্তে রাজমহল পাহাড় ভিজে লাল হয়ে গিয়েছিল এবং তারা ইংরেজদের সামরিক আইন ও উন্নত অস্ত্রের কাছে পরাজয় স্বীকার করে নেয়, তবুও এই রক্তপাত বা পরাজয় সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়নি। বিদ্রোহের পর ইংরেজরা সাঁওতাল অধ্যুষিত এলাকাগুলি নিয়ে অনেক সচেতন হয়ে ওঠে এবং এই অঞ্চলগুলি নিয়ে সাঁওতাল পরগনা নামে একটি পৃথক জেলা গঠন করা হয়। সেখানে কোম্পানি আইনবিধি কার্যকর না করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, নতুন পুলিশ থানা ও আদালত গঠিত হয়, এবং মহাজনদের সুদের হারও নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। এই বিদ্রোহ উপজাতি সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষদের নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। ঐতিহাসিক সুপ্রকাশ ঘোষের কথায়, ‘সাঁওতাল বিদ্রোহের মাদলধ্বনি ভারতীয় কৃষিশক্তিকে জাগ্রত করেছে, আত্মপ্রতিষ্ঠার পথনির্দেশ করেছে।’ সুতরাং, পরাজয় সত্ত্বেও বিদ্রোহটি সাঁওতালদের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ও আইনি সুরক্ষা অর্জন করেছিল এবং তাদের মধ্যে অধিকার সচেতনতা বৃদ্ধি করেছিল, তাই একে সম্পূর্ণ ব্যর্থ বলা যায় না।
ঘ. ১৮৯৯-১৯০০ খ্রিস্টাব্দে মুন্ডা উপজাতিরা কেন বিদ্রোহের পথে অগ্রসর হয়েছিল?
উত্তর: ১৮৯৯-১৯০০ খ্রিস্টাব্দে মুন্ডা উপজাতিরা বিদ্রোহের পথে অগ্রসর হয়েছিল কারণ:
(i) সহজ, সরল, স্বাধীন জীবনে অভ্যস্ত মুন্ডা জনগোষ্ঠী তাদের জীবনে ও অর্থনীতিতে ইংরেজ, ভূস্বামী ও মহাজনদের অনুপ্রবেশ মেনে নিতে পারেনি।
(ii) ইংরেজরা মুন্ডাদের প্রাচীন খুঁটকাঠি বা যৌথ জমিব্যবস্থা বাতিল করে নতুন জমিদারি ব্যবস্থার প্রবর্তন করে, যার ফলে মুন্ডারা নগদে খাজনা দিতে না পারলে উৎখাত হত।
(iii) তাদের ওপর অধিক কর ধার্য করা হতো এবং কর পরিশোধ করতে গিয়ে তারা মহাজনের দ্বারস্থ হতো, যেখানে মহাজনরা তাদের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে হিসাবে কারচুপি করত।
(iv) ইংরেজ বিচারব্যবস্থাতে মুন্ডাদের নিজস্ব আইনকানুন স্বীকৃতি হারায়, যা মুন্ডাদের সামাজিক মর্যাদায় আঘাত হানে।
(v) মিশনারিরা মুন্ডাদের সনাতন রীতিনীতি ও ধর্মের সমালোচনা করায় মুন্ডাদের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে।
ঙ. তিতুমির ওয়াহাবি আন্দোলনকে পরিচালনা করার ক্ষেত্রে কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন?
উত্তর: তিতুমির ওয়াহাবি আন্দোলনকে পরিচালনা করার ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলি গ্রহণ করেছিলেন:
(i) তিনি বাংলায় সৈয়দ আহমদের ওয়াহাবি মতাদর্শ প্রচার করেন এবং ইসলাম ধর্মের সংস্কারে ব্রতী হন।
(ii) জমিদার ও নীলকর সাহেবদের অত্যাচার উপলব্ধি করে তিনি দরিদ্র হিন্দু-মুসলমান কৃষকদের জন্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ করেন।
(iii) তিনি জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে ওয়াহাবিদের সশস্ত্র সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন এবং খুলনা, যশোর, রাজশাহি, ঢাকা, মালদহ, ২৪ পরগনা প্রভৃতি অঞ্চলে বিদ্রোহ ছড়িয়ে দেন, যাতে তাঁতি, দিনমজুর, কৃষক সহ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ যোগ দেয়।
(iv) বিদ্রোহী মানুষের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে তিনি নারকেলবেড়িয়া গ্রামে বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করেন, সেখানে সার্বভৌমত্বের প্রতীক হিসাবে পতাকা উড্ডীন করেন এবং নিজেকে ‘বাদশাহ’ বলে ঘোষণা করেন।
(v) তিনি জমিদারদের খাজনা দেওয়া বন্ধ করার নির্দেশ দেন, একটি সুশৃঙ্খল সৈন্যবাহিনী গড়ে তোলেন এবং বিভিন্ন জমিদারের কাছে পরোয়ানা জারি করে সৈন্যবাহিনীর জন্য খাদ্যশস্য দাবি করেন।
চ. নীল বিদ্রোহ সফল হওয়ার পিছনে কী কারণ ছিল বলে তোমার মনে হয়?
উত্তর: নীল বিদ্রোহ সফল হওয়ার পিছনে কারণগুলি ছিল:
(i) চাষিদের মূল উদ্দেশ্য ছিল শুধুমাত্র নীলকরদের অত্যাচার থেকে মুক্তি পাওয়া নয়, বরং বাংলার বুক থেকে নীল চাষের অবলুপ্তি সাধন, এবং তাদের দৃঢ় সংকল্প ছিল “বরং মৃত্যু স্বীকার করব তবু নীল বুনব না”।
(ii) চাষিদের বিস্ময়কর উদ্যোগ, সংগঠন, শৃঙ্খলা এবং হিন্দু-মুসলিম একতা।
(iii) অনেক ছোট ছোট জমিদার এবং বাংলার বুদ্ধিজীবীদের (যেমন হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও দীনবন্ধু মিত্র) আন্তরিক সমর্থন।
(iv) খ্রিস্টান মিশনারীদের সমর্থন এবং নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিবাদ।
(v) বিদ্রোহীদের অভিনব যুদ্ধের কৌশল, যেমন তির-ধনুক, ইট-পাটকেল এবং কাঁচা বেল ব্যবহার করা।
(vi) সাঁওতাল বিদ্রোহ ও মহাবিদ্রোহের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ইংরেজ সরকারের সংযত অবস্থান, তদন্ত কমিশন গঠন এবং শেষ পর্যন্ত চাষিদের নীলচাষে বাধ্য করা হবে না এই মর্মে সরকারি বিবৃতি জারি করা।
ব্যাখ্যাধর্মী প্রশ্ন
ক. সাঁওতাল বিদ্রোহের কারণ ও বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো।
উত্তর: কারণ: ভারতের ইতিহাসে আদিবাসী বিদ্রোহগুলির মধ্যে সাঁওতাল হুল বা সাঁওতাল বিদ্রোহ ছিল সবচেয়ে ব্যাপক। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের পর জমিদারদের অতিরিক্ত খাজনার দাবিতে সাঁওতালরা অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। আঠারো শতকের দ্বিতীয় ভাগে তারা নিজের ঘরবাড়ি ছেড়ে রাজমহল পাহাড়ের পাদদেশে ভাগলপুর ও বীরভূম অঞ্চলে এসে স্বাধীনভাবে বসতি স্থাপন করে, যার নাম দেওয়া হয় দামিন-ই-কোহ বা মুক্তাঞ্চল। কিন্তু সেখানেও ইংরেজ কর্মচারী, বাঙালি জমিদার, মহাজন ও দারোগার আগমনে সাঁওতালদের শান্তি বিঘ্নিত হয়। এরা সাঁওতালদের অজ্ঞতা ও নিরক্ষরতার সুযোগ নিয়ে নির্মম শোষণ ও অত্যাচার শুরু করে দেয়। কোম্পানির খাজনা সংগ্রাহক, পুলিশ কর্মচারীর জুলুম মাত্রা ছাড়ায়। মহাজনদের ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে পড়া অসহায় সাঁওতালদের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে। মহাজনদের থেকে ঋণ নেওয়ার সময় চুক্তিপত্রে সাঁওতালদের আঙুলের ছাপ নেওয়া হত এবং তাদের কামিয়াতি ও হারওয়াহি—এই দু’ধরনের শ্রম দিতে হত। এছাড়া, রেলপথের ইংরেজ কর্মচারীরা বিনামূল্যে সাঁওতাল অধিবাসীদের নিকট হইতে বলপূর্বক পাঁঠা, মুরগি প্রভৃতি কাড়িয়া লইতেন এবং সাঁওতালগণ প্রতিবাদ করিলে তাদের উপর অত্যাচার করিতেন।
বৈশিষ্ট্য: সাঁওতাল বিদ্রোহের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হল সাঁওতাল জাতিকে সংগঠিত ও বিদ্রোহে অনুপ্রানিত করার উদ্দেশ্যে তাদের ধর্মীয়ভাবনাকে কাজে লাগানো হয়। সিধু কানু ঘোষণা করেন সাঁওতালদের ঠাকুর তাদের নির্দেশ দিয়েছেন যে সমস্ত সাঁওতালকে শত্রুদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে শামিল হতে হবে। সাঁওতাল পুরাণ, লোকগাথা ও সৃষ্টি তত্ত্বে ব্যবহৃত ভাষা ও প্রতীক ব্যবহার করে সাঁওতালদের ঐক্যবদ্ধ করা হয়। বিদ্রোহে সাঁওতাল নেতারা সাঁওতাল পুরাণ, লোকগাথা ও সৃষ্টিতত্ত্বে ব্যবহৃত ভাষা, প্রতীক ব্যবহার করেছিলেন। সাঁওতাল বিদ্রোহ-ই প্রথম আদিবাসী বিদ্রোহ যেখানে বিদ্রোহীদের সংগঠন (হুল) গড়ে তোলা হয়েছিল। সিধু কানুর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সাঁওতালরা বিদেশি বা ‘দিকু’দের বিতাড়িত করার জন্য সংকল্পবদ্ধ হয়। ১৮৫৫ সালে জুলাই মাসে সাঁওতালরা তাদের সংগঠন ‘হুল’ গঠন করে। গ্রামে গ্রামে সাঁওতাল ও অন্যান্য উপজাতির মানুষের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের প্রতীক হিসাবে শাল গাছের ডাল পাঠানো হয়। সেই বছরই ৩০ জুন ভাগনাডিহির মাঠে ৪০০ গ্রামের প্রতিনিধি হিসাবে হাজার হাজার সাঁওতাল এসে মিলিত হয় এবং সিধু, কানু, চাঁদ, ভৈরব প্রমুখ নেতাদের উপস্থিতিতে শপথ নেয়। সাঁওতালদের গণ অভুত্থানে ‘সত্যের শাসন’, ‘ন্যায়বিচারের’ যুগের আগমনবার্তা ঘোষিত হয়। শুধুমাত্র সাঁওতালরাই নয়-স্থানীয় কুমোর, তেলি, কর্মকার, গোয়ালা, মুসলিম তাঁতি, চামার, ডোম প্রভৃতি সম্প্রদায় ও পেশার মানুষেরাও এই বিদ্রোহে যোগদান করেছিল। কামাররা ছিল বিদ্রোহীদের সক্রিয় সহচর। এই বিদ্রোহ কেবলমাত্র জমিদার ও মহাজন বিরোধী ছিল না-স্পষ্টতই এই বিদ্রোহ ছিল ব্রিটিশ বিরোধী।
খ. মুণ্ডা বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করো।
উত্তর: বৈশিষ্ট্য: মুন্ডা বিদ্রোহের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল এই বিদ্রোহকে সংগঠিত করার উদ্দেশ্যে বিরসা মুণ্ডা আদিবাসী সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ভাবনাকে আশ্রয় করেন। তিনি মুণ্ডা চাষিদের ধর্মীয়ভাবে উদ্দীপিত করে সংঘবদ্ধ করেন। বিরসা ঘোষণা করেন তিনি ঈশ্বরের দূত, মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দূর করার অলৌলিক ক্ষমতা তার রয়েছে। খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী বহু মুন্ডা বিরসার সঙ্গে যোগদান করেন। অধ্যাপক বিনয় চৌধুরীর মতে, বিরসার লক্ষ ছিল মুণ্ডা সমাজের নৈতিক ও ধর্মীয় পুনর্জাগরণের দ্বারা ‘স্বাধীন মুন্ডারাজ্য গঠন।’ স্বাধীন মুন্ডারাজ্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে জায়গিরদার, ঠিকাদার, মহাজন, খ্রিস্টানদের হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। ১৮৯৯-১৯০০ খ্রিস্টাব্দে মুন্ডারা কিছুদিনের জন্য হলেও রাঁচি, হাজারিবাগ, ছোটনাগপুর অঞ্চলে ইংরেজ শাসন লোপ করে দেন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে মুন্ডা বিদ্রোহ ছিল আদিবাসীদের শেষ সশস্ত্র সংগ্রাম। বিরসা মুন্ডার আদর্শে অনুপ্রাণিত মুন্ডারা সামরিক শক্তিতে বলীয়ান ইংরেজদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পিছপা হয়নি।
গুরুত্ব: বিদ্রোহ দমনের পর সরকার মুন্ডাদের অভাব-অভিযোগ লাঘব করতে সচেষ্ট হয়। ছোটোনাগপুর প্রজাস্বত্ব আইন পাস করে মুন্ডাদের খুঁটকাঠি অধিকার স্বীকার করে নেওয়া হয়। বাধ্যতামূলক শ্রমদান, বেটবেগারি প্রথা নিষিদ্ধ হয়। বিরসার আত্মত্যাগ মুন্ডাদের চোখে স্বাধীনতার স্বপ্ন এঁকে দিয়ে যায়।
গ. ওয়াহাবি আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য কী ছিল? বাংলায় তিতুমিরের নেতৃত্বে যে আন্দোলন সংগঠিত হয় তা কি ওয়াহাবি আন্দোলনের সেই উদ্দেশ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল? যুক্তি দাও।
উত্তর: মূল উদ্দেশ্য: ওয়াহাবি আন্দোলনের মূল প্রবর্তক আবদুল ওয়াহাব এবং ভারতে এর নেতা সৈয়দ আহমদ ইসলাম ধর্মের পুনরুজ্জীবনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। সৈয়দ আহমদ মনে করতেন যে ইংরেজদের উপস্থিতিতে ভারতবর্ষ দার-উল হারব বা শত্রু রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। তাই ওয়াহাবি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তিনি ভারতবর্ষকে দার-উল-ইসলাম বা ধর্মরাজ্যে পরিণত করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন।
তিতুমিরের আন্দোলন ও তার পরিধি: বাংলায় সৈয়দ আহমদের মতাদর্শ প্রচারের দায়িত্ব নেন তিতুমির (মির নিসার আলি)। মক্কায় সৈয়দ আহমদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে দেশে ফিরে তিনি ওয়াহাবি ধর্মমত অনুসারে ইসলাম ধর্মের সংস্কারে ব্রতী হন। কিন্তু শীঘ্রই তিনি উপলব্ধি করেন জমিদার ও নীলকর সাহেবদের নির্মম অত্যাচার সাধারণ মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। তাই তিনি দরিদ্র হিন্দু-মুসলমান কৃষকদের উপযোগী সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ করেন এবং জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। এই বিদ্রোহ খুলনা, যশোর, রাজশাহি, ঢাকা, মালদহ, ২৪ পরগনা প্রভৃতি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এবং এতে তাঁতি, দিনমজুর, কৃষক বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ যোগদান করে। ক্রমেই তিতুমিরের নেতৃত্বে ‘ওয়াহাবি’ আন্দোলন ধর্মের আবরণ ত্যাগ করে মহাজন, নীলকর সাহেব, রাজস্বকর্মীদের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে এবং শেষে এই বিদ্রোহ সর্বোপরি ব্রিটিশ শোষণের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সশস্ত্র আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে। ওয়াহাবি বিদ্রোহ প্রথমে ধর্মীয় আন্দোলন হিসাবে শুরু হলেও, পরবর্তীকালে তিতুমিরের হাত ধরে তা রাজনৈতিক তথা অর্থনৈতিক সংগ্রামে পরিণত হয়। যদিও এই আন্দোলন মূলত মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল এবং অনেক কৃষক এতে যোগ দেয়নি, তবুও একে শুধুমাত্র ধর্মীয় উদ্দেশ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ বলা যায় না, কারণ এটি ব্রিটিশ বিরোধী এবং অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামে রূপান্তরিত হয়েছিল। ‘দি ওয়াহাবি মুভমেন্ট’ গ্রন্থের লেখক কেয়াম-উদ্দিন আহমদ এই আন্দোলনকে ইংরেজ বিরোধী ভারতের স্বাধীনতার যুদ্ধ বলে অভিহিত করেছেন। সুতরাং, বাংলায় তিতুমিরের আন্দোলন ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রাথমিক ধর্মীয় সংস্কারের উদ্দেশ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তা ব্রিটিশ শাসন ও অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে এক ব্যাপকতর সংগ্রামে পরিণত হয়েছিল।
ঘ. ফরাজি আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব আলোচনা করো।
উত্তর: বৈশিষ্ট্য: দুদু মিয়াঁর নেতৃত্বে সংঘটিত ফরাজি আন্দোলনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল-ফরাজিরা নিজস্ব আইন প্রণয়ন করেছিলেন এবং তাদের নিজস্ব আদালতও ছিল। তারা সরকারি আইন, আদালতকে সম্পূর্ণ রূপে বর্জন করার নীতি গ্রহণ করেছিলেন। এই আদালতগুলি হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল কারণ মানুষ মনে করত এই আদালতগুলি তাদের জমিদারদের অত্যাচার থেকে রক্ষা করবে। দুদু মিয়ার নেতৃত্বে পূর্ববঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ফরাসিরাজ কায়েম করা হয়। তিনি পূর্ববঙ্গকে কতকগুলি ভাগে বিভক্ত করে প্রত্যেক বিভাগের জন্য একজন করে খলিফা নিযুক্ত করেন। তিনি অনুগামীদের কাছ থেকে ফরাজি কর গ্রহণ করতেন এবং কর বাবদ প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে সরকারি আদালতে দরিদ্র কৃষকদের হয়ে মামলা লড়া ও আন্দোলন চালানোর ব্যয় নির্বাহ করা হত।
গুরুত্ব: ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন হিসাবে শুরু হলেও ফরাজি আন্দোলন শেষপর্যন্ত রাজনৈতিক আন্দোলনের স্বীকৃতি অর্জন করেছিল। দুদুমিয়াঁর নেতৃত্বে বিকল্প সরকার, সৈন্যবাহিনী, শাসন ও আদালত গঠন নিঃসন্দেহে আন্দোলনকে এক বৈপ্লবিক রূপ দান করেছিল। তবে ফরাজি আন্দোলনের সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি হিন্দু-মুসলিম কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ করতে পারেনি। আন্দোলন আপাতভাবে ব্যর্থ হলেও তা পরবর্তী কৃষক আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল।
ঙ. নীল বিদ্রোহের কারণ সম্পর্কে লেখো। নীল বিদ্রোহের ঐতিহাসিক গুরুত্ব কী ছিল বলে তোমার মনে হয়?
উত্তর: কারণ: নীল বিদ্রোহের প্রধান কারণ ছিল নীলকর সাহেবদের অত্যাচার ও শোষণ। নীলকররা প্রথম থেকেই কৃষকদের নীলচাষে বাধ্য করত। তারা সামান্য কিছু দাদন দিয়ে কৃষকদের সঙ্গে প্রতারণামূলক চুক্তি করত এবং বাজার দরের চেয়ে অনেক কম দামে নীল ক্রয় করত। কৃষকদের তাদের সেরা জমিতে নীলচাষ করতে বাধ্য করা হত এবং টাকা দেওয়ার সময় নির্ধারিত দরও ঠিকমতো দেওয়া হত না। নীলচাষের ভিত্তি ছিল ভূমিদাসত্ব ও বেগার শ্রম। একবার দাদন নিলে কৃষকদের মুক্তির পথ থাকত না। নীলকররা ছিল নির্মম ও বর্বর; নীলচাষে বাধ্য করার জন্য তারা চরম নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা নিত। নীলচাষিদের ওপর নীলকুঠির লাঠিয়ালদের নির্মম অত্যাচার, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া, স্ত্রী-কন্যাদের লাঞ্ছিত করা, কারখানার গুদাম ঘরে আটকে রাখা নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে উঠেছিল। নীলকররা আইনের ঊর্ধ্বে ছিল এবং বেশিরভাগ ইউরোপীয় বিচারক তাদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখাতেন।
ঐতিহাসিক গুরুত্ব: সাঁওতাল বিদ্রোহ এবং ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা লাভ করে ইংরেজ সরকার নীলবিদ্রোহের ক্ষেত্রে অনেক সংযত অবস্থান গ্রহণ করে। নীলচাষের সমস্যাগুলো নিয়ে তদন্ত করার জন্য সরকার ‘ইন্ডিগো কমিশন’ গঠন করে। কমিশনের রিপোর্টে নীলকরদের দুর্নীতি ও অত্যাচারের কথা প্রকাশিত হয়। ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরে সরকার এক বিবৃতি জারি করে ঘোষণা করে যে চাষিদের আর নীলচাষে বাধ্য করা যাবে না এবং নীলচাষ সংক্রান্ত যাবতীয় বিরোধ আইনের সাহায্যে মীমাংসা করা হবে। নীল বিদ্রোহ ছিল যথার্থ অর্থে এক গণবিদ্রোহ এবং সংগ্রামী কৃষক ও শিক্ষিত বাঙালির মিলিত সংগ্রামের দৃষ্টান্ত। সামাজিক গুরুত্ব, সংগঠন, ব্যাপকতা ও পরিণতির দিক থেকে এই বিদ্রোহ পূর্বের সব কৃষক আন্দোলনের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ছিল। ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’র সম্পাদক শিশির কুমার ঘোষ যথার্থই লিখেছিলেন যে, “এই নীল বিদ্রোহই সর্বপ্রথম দেশের মানুষকে রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংঘবদ্ধ হইবার প্রয়োজনীয়তা শিক্ষা দিয়েছিল।”
অতিরিক্ত (Extras)
বহুনির্বাচনী প্রশ্ন (MCQs)
১. অরণ্য আইনের প্রবর্তনের ফলে আদিবাসীদের জীবনে কী প্রভাব পড়ে?
ক. শান্ত জীবন বজায় থাকে
খ. জীবন ধীরে ধীরে উন্নত হয়
গ. জীবন অশান্ত হয়ে ওঠে
ঘ. কোন পরিবর্তন হয় না
উত্তর: গ. জীবন অশান্ত হয়ে ওঠে
৩০. তরিকা-ই-মহম্মদীয়া আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য কী ছিল?
ক. ধর্মীয় বিশুদ্ধতা
খ. জমিদারদের ক্ষমতা বৃদ্ধি
গ. কৃষকদের সমর্থন
ঘ. ইংরেজ শাসনের অবসান
উত্তর: ক. ধর্মীয় বিশুদ্ধতা
প্রশ্ন ও উত্তর (Questions, Answers)
1. অরণ্য আইন কী?
উত্তর: অরণ্য আইন হল ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক প্রবর্তিত একটি আইন যার দ্বারা আদিবাসীদের ঝুমচাষ নিষিদ্ধ করা হয় এবং অরণ্য সম্পদের ওপর একচেটিয়া অধিকার স্থাপনের উদ্দেশ্যে আদিবাসীদের কাঠ সংগ্রহ ও গোচারণের অধিকারকেও নিয়ন্ত্রণ করা শুরু হয়। এই আইন প্রবর্তন এবং ঔপনিবেশিক অত্যাচারে আদিবাসীদের জীবন চরম দুর্দশার সম্মুখীন হয়।
35. নীল বিদ্রোহ সংঘটিত হওয়ার মূল কারণগুলি ব্যাখ্যা করো এবং এর ঐতিহাসিক তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।
উত্তর: নীল বিদ্রোহ সংঘটিত হওয়ার মূল কারণগুলি ছিল:
(i) চাষে বাধ্য করা: নীলকররা প্রথম থেকেই কৃষকদের নীলচাষে বাধ্য করত। কৃষকরা তাঁদের সেরা জমিতে নীলচাষ করতে বাধ্য হতেন।
(ii) প্রতারণামূলক চুক্তি ও দাদন: নীলকর সাহেবরা সামান্য কিছু দাদন (অগ্রিম অর্থ) দিয়ে কৃষকদের সঙ্গে প্রতারণামূলক চুক্তি করত। একবার দাদন নিলে কৃষকদের আর মুক্তির পথ খোলা থাকত না।
(iii) অন্যায্য মূল্য: বাজার দরের থেকে অনেক কম দামে ইংরেজরা নীল ক্রয় করত। টাকা দেওয়ার সময় নির্ধারিত দরও ঠিকমতো দেওয়া হত না।
(iv) ভূমিদাসত্ব ও বেগার শ্রম: নীলচাষের ভিত্তি ছিল ভূমিদাসত্ব ও বেগার শ্রম।
(v) নির্মম অত্যাচার: নীলকররা ছিল নির্মম ও বর্বর প্রকৃতির। নীলচাষে বাধ্য করার জন্য তারা চরম নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল। নীলকুঠির লাঠিয়ালদের নির্মম অত্যাচার, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া, স্ত্রী-কন্যাদের লাঞ্ছিত করা, কারখানার গুদাম ঘরে নীলচাষিদের আটকে রাখা নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে উঠেছিল।
(vi) আইনি সুরক্ষার অভাব: নীলকররা ছিল সমস্ত আইনের ঊর্ধ্বে। বেশিরভাগ ইউরোপীয় বিচারক নীলকরদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখাতেন, ফলে কৃষকরা আইনি পথে প্রতিকার পেত না।
ঐতিহাসিক তাৎপর্য:
(i) সরকারি হস্তক্ষেপ: সাঁওতাল বিদ্রোহ এবং ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ইংরেজ সরকার নীলবিদ্রোহের ক্ষেত্রে অনেক সংযত অবস্থান গ্রহণ করে। সরকার নীলচাষের সমস্যাগুলো নিয়ে তদন্ত করার জন্য ‘ইন্ডিগো কমিশন’ গঠন করে।
(ii) নীলকরদের মুখোশ উন্মোচন: কমিশনের রিপোর্টে নীলকরদের দুর্নীতি ও অত্যাচারের কথা মানুষের সামনে তুলে ধরা হয়।
(iii) চাষিদের অধিকার প্রতিষ্ঠা: ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরে সরকার এক বিবৃতি জারি করে ঘোষণা করে যে চাষিদের আর নীলচাষে বাধ্য করা যাবে না এবং নীলচাষ সংক্রান্ত যাবতীয় বিরোধ আইনের সাহায্যে মীমাংসা করতে হবে। এর ফলে ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দের শেষে বাংলার বুকে নীলচাষ বন্ধ হয়ে যায়।
(iv) গণবিদ্রোহের চরিত্র: নীল বিদ্রোহ ছিল যথার্থ অর্থে এক গণবিদ্রোহ। এই আন্দোলন ছিল সংগ্রামী কৃষক ও শিক্ষিত বাঙালির মিলিত সংগ্রামের দৃষ্টান্ত। সামাজিক গুরুত্ব, সংগঠন, ব্যাপকতা ও পরিণতিতে এই বিদ্রোহ পূর্বের সব কৃষক আন্দোলনের থেকে শ্রেষ্ঠ ছিল।
(v) রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ: ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’র সম্পাদক শিশির কুমার ঘোষ যথার্থই লিখেছিলেন যে, “এই নীল বিদ্রোহই সর্বপ্রথম দেশের মানুষকে রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংঘবদ্ধ হইবার প্রয়োজনীয়তা শিক্ষা দিয়াছিল।”
Get notes of other classes and subjects
NBSE | SEBA/AHSEC |
NCERT | TBSE |
WBBSE/WHCHSE | ICSE/ISC |
BSEM/COHSEM | MBOSE |
Share Feedback | Question Papers |