বিশ শতকের ভারতে নারী..: WBBSE ক্লাস 10 ইতিহাস (History)

বিশ শতকের ভারতে নারী, ছাত্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আন্দোলন বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ 1
Share + Two Real PDF + Guest PDF
WhatsApp

এখানে (chapter 7) বিশ শতকের ভারতে নারী, ছাত্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আন্দোলন বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ: WBBSE ক্লাস 10 ইতিহাস (History) (Bengali medium) আধুনিক ভারতের ইতিহাস ও পরিবেশ (Adhunik Bharater Itihas O Poribesh)-এর উত্তর, ব্যাখ্যা, সমাধান, নোট, অতিরিক্ত তথ্য, এমসিকিউ এবং পিডিএফ পাওয়া যাবে। নোটগুলো শুধুমাত্র রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করুন এবং প্রয়োজনমতো পরিবর্তন করতে ভুলবেন না।

Select medium
English medium notes
Bengali medium notes
OFN – Free vs Registered

সারাংশ (summary)

বিশ শতকের ভারতে নারী, ছাত্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আন্দোলন: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ (Bish Shataker Bharate Nari, Chhatra o Prantik Janagoshthir Andolon: Boishishto o Bishleshon)- উনিশ শতকে নারী শিক্ষার প্রসার ঘটেছিল, যা নারীদের নিজেদের অবস্থা ও দেশ সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। বিশ শতকের শুরুতে জাতীয়তাবাদীরা দেশকে মা হিসাবে কল্পনা করতে শুরু করেন, যেমন বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে দেখা যায়। এই ধারণা নারীদের জাতীয় আন্দোলনে যোগ দিতে উৎসাহিত করে।

স্বদেশি আন্দোলনের সময় নারীরা মূলত ঘরের কাজে সাহায্য করার মতো করেই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। যেমন বিদেশি জিনিস ব্যবহার না করা, দেশি জিনিস ব্যবহার করা, অরন্ধন দিবস পালন করা। সরলাদেবী চৌধুরানী বা ননীবালা দেবীর মতো কেউ কেউ সরাসরি আন্দোলনে অংশ নেন বা বিপ্লবীদের সাহায্য করেন। জাতীয়তাবাদীরা মহিলাদের সমর্থন পেতে ‘মা লক্ষ্মী’কে একটি প্রতীকের মতো ব্যবহার করেন, বোঝানো হয় যে বঙ্গভঙ্গের জন্য মা লক্ষ্মী দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। অনেক মহিলা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অরন্ধন পালন করেন, চরকা কাটেন।

পরে অসহযোগ ও আইন অমান্য আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ অনেক বাড়ে। বাসন্তী দেবী, সরোজিনী নাইডু, কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ নেত্রী গ্রামের মহিলাদেরও আন্দোলনে যুক্ত করেন। তারা পিকেটিং, লবণ আইন ভাঙার মতো কাজে সক্রিয় ছিলেন। ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অরুণা আসফ আলি, সুচেতা কৃপালিনী, মাতঙ্গিনী হাজরার মতো নারীরা আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। মাতঙ্গিনী হাজরা পতাকা হাতে পুলিশের গুলিতে মারা যান। সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনেও নারীরা শুধু সাহায্যকারী নয়, সরাসরি যোদ্ধা হিসাবে যোগ দেন, যেমন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্ত, বীণা দাস। লীলা রায়ের ‘দীপালি সংঘ’ মেয়েদের বিপ্লবী কাজের জন্য তৈরি করত। সুভাষচন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজে ‘ঝাঁসির রানি ব্রিগেড’ নামে একটি নারীবাহিনীও ছিল।

ছাত্ররাও দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে বড় ভূমিকা নেয়। বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে ছাত্ররা ছিল ‘স্বনিয়োজিত প্রচারক’। তারা পিকেটিং, বয়কট করে। ইংরেজ সরকার ভয় পেয়ে ছাত্রদের বিরুদ্ধে সার্কুলার জারি করলে, তার প্রতিবাদে ‘অ্যান্টি-সার্কুলার সোসাইটি’ তৈরি হয় বিকল্প শিক্ষার জন্য। অসহযোগ ও আইন অমান্য আন্দোলনে ছাত্ররা স্কুল-কলেজ বয়কট করে। ভারত ছাড়ো আন্দোলনে ছাত্রসমাজ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দেয়, ধর্মঘট, পিকেটিং করে এবং পুলিশের অত্যাচার সহ্য করে। বহু ছাত্র সশস্ত্র বিপ্লবী দলেও যোগ দেয়, যেমন ক্ষুদিরাম বসু, প্রফুল্ল চাকী, বিনয়-বাদল-দীনেশ। যতীন দাস জেলে অনশন করে মারা যান। ভগৎ সিং, বটুকেশ্বর দত্ত প্রমুখ ছাত্র বিপ্লবী হিসাবে পরিচিত। আজাদ হিন্দ ফৌজের বন্দি সেনাদের মুক্তির দাবিতে এবং রশিদ আলি দিবসে ছাত্ররা বড় আন্দোলন করে।

বিশ শতকে দলিত বা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীও নিজেদের অধিকারের জন্য আন্দোলন করে। মহারাষ্ট্রে জ্যোতিবা ফুলে ‘সত্যশোধক সমাজ’ প্রতিষ্ঠা করেন ব্রাহ্মণদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে। দক্ষিণ ভারতে ই ভি রামস্বামী নায়কার ‘সেলফ রেসপেক্ট’ আন্দোলন শুরু করেন। কেরালায় নারায়ণ গুরু দলিতদের জন্য কাজ করেন। গান্ধিজি অস্পৃশ্যতা দূর করার চেষ্টা করেন এবং দলিতদের ‘হরিজন’ (ঈশ্বরের সন্তান) নাম দেন। কিন্তু ডঃ বি আর আম্বেদকর দলিতদের জন্য শিক্ষা, চাকরি ও রাজনৈতিক অধিকারের উপর জোর দেন। তিনি গান্ধিজির হরিজন আন্দোলনের সঙ্গে একমত ছিলেন না এবং দলিতদের জন্য পৃথক নির্বাচনের দাবি করেন, যা পরে পুনা চুক্তির মাধ্যমে সমাধান হয়। আম্বেদকর দলিতদের সংগঠিত করেন এবং সংবিধান রচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে অস্পৃশ্যতাকে বেআইনি ঘোষণা করান। বাংলায় নমঃশূদ্ররাও হরিচাঁদ ঠাকুর, গুরুচাঁদ ঠাকুর ও যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের নেতৃত্বে নিজেদের সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকারের জন্য আন্দোলন করে।

পাঠ্য প্রশ্ন ও উত্তর (Prantik textbook)

সঠিক উত্তরটি নির্বাচন করো

(ক) ‘বঙ্গলক্ষ্মীর ব্রতকথা’ রচনা করেছিলেন—

(i) সরলাদেবী চৌধুরানি
(ii) রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী
(iii) গিরিজাসুন্দরী দেবী
(iv) চারণ কবি মুকুন্দ দাস

উত্তর: (ii) রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী

(খ) ভারতে প্রথম দেবদাসী প্রথার বিলোপসাধনের জন্য বিল এনেছিলেন—

(i) মুথুলক্ষ্মী রেড্ডি
(ii) অ্যানি বেসান্ত
(iii) সরোজিনী নাইডু
(iv) অরুণা আসফ আলি

উত্তর: (i) মুথুলক্ষ্মী রেড্ডি

(গ) অ্যান্টি-সার্কুলার সোসাইটি গঠন করেছিলেন—

(i) শচীন্দ্রপ্রসাদ বসু
(ii) সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়
(iii) সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
(iv) অরবিন্দ ঘোষ

উত্তর: (i) শচীন্দ্রপ্রসাদ বসু

(ঘ) বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দলের উদ্দেশ্য ছিল—

(i) জাতীয় শিক্ষার প্রসার ঘটানো
(ii) নরমপন্থী আন্দোলন পরিচালনা করা
(iii) বৈপ্লবিক আন্দোলন গড়ে তোলা
(iv) এর কোনোটিই নয়।

উত্তর: (iii) বৈপ্লবিক আন্দোলন গড়ে তোলা

(ঙ) হরিজন পত্রিকাটি প্রকাশ করেন—

(i) বি. আর. আম্বেদকর
(ii) গান্ধিজি
(iii) ই. ভি. রামস্বামী নায়কার
(iv) জ্যোতিবা ফুলে

উত্তর: (ii) গান্ধিজি

নীচের বিবৃতি গুলির মধ্যে কোনটি ঠিক কোটি ভুল লেখো

(ক) বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় সরলাদেবী ভারতী পত্রিকায় বিভিন্ন প্রবন্ধ প্রকাশের মাধ্যমে নারীশক্তিকে উজ্জীবিত করে তোলেন।

উত্তর: ঠিক

কারণ: স্বদেশি আন্দোলনের সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাগনি সরলাদেবী চৌধুরানী ‘ভারতী’ পত্রিকায় বিভিন্ন প্রবন্ধ প্রকাশের মাধ্যমে নারীশক্তিকে উজ্জীবিত করে তুলেছিলেন।

(খ) অ্যানি বেসান্তের উদ্যোগে ভারতীয় মহিলা সমিতি গঠিত হয়েছিল।

উত্তর: ভুল

কারণ: সরোজিনী নাইডু মুথুলক্ষ্মী রেড্ডির সঙ্গে ‘ভারতীয় মহিলা সমিতি’ (WIA) স্থাপন করেছিলেন।

(গ) আইন অমান্য আন্দোলনে সম্ভ্রান্ত পরিবারের মহিলারা অংশগ্রহণ করেননি।

উত্তর: ভুল

কারণ: আইন অমান্য আন্দোলনের সময় বিভিন্ন বিক্ষোভ সমাবেশে সম্ভ্রান্ত পরিবারের মহিলারা বিপুল সংখ্যায় যোগদান করেছিলেন।

(ঘ) হেমচন্দ্র ঘোষ বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দল তৈরি করেছিলেন।

উত্তর: ঠিক

কারণ: ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা কংগ্রেস অধিবেশনের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর কিছু সদস্যকে নিয়ে হেমচন্দ্র ঘোষ ঢাকায় ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স’ দল গঠন করেন।

(ঙ) ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ‘সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারাকে’ গান্ধিজি সমর্থন করেছিলেন।

উত্তর: ভুল

কারণ: ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ম্যাকডোনাল্ড ঘোষিত ‘সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা’র মাধ্যমে হিন্দু সমাজকে বর্ণহিন্দু ও অনুন্নত শ্রেণি—এই দুই ভাগে ভাগ করার বৈষম্যমূলক নীতির বিরুদ্ধে গান্ধিজি প্রতিবাদে সরব হন এবং জেলবন্দি অবস্থায় অনশন শুরু করেন।

নীচের বিবৃতির সঙ্গে সবচেয়ে মানানসই ব্যাখ্যাটি বেছে নাও

(ক) জাতীয় আন্দোলনে নারীদের যোগদানে রক্ষণশীল পুরুষ সমাজও স্তম্ভিত হয়ে যায়—

ব্যাখ্যা—

(i) আন্দোলনে নারী অংশগ্রহণের চেহারা ছিল মূলত ঘরোয়া।
(ii) নারী শিক্ষা প্রসার, গ্রামীণ শিল্পের বিকাশে নারী সমাজ যোগ দেয়।
(iii) বিভিন্ন বিক্ষোভ সমাবেশে সম্ভ্রান্ত পরিবারের মহিলারা বিপুল সংখ্যায় যোগদান করেন।

উত্তর: ব্যাখ্যা—(iii) বিভিন্ন বিক্ষোভ সমাবেশে সম্ভ্রান্ত পরিবারের মহিলারা বিপুল সংখ্যায় যোগদান করেন।

(খ) কার্লাইল সার্কুলার বিরুদ্ধে অ্যান্টি-সার্কুলার সোসাইটি গঠিত হয়—

ব্যাখ্যা—

(i) সরকারি নীতির সমালোচনা করার জন্য।
(ii) সরকারি আদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কৃত ছাত্রদের বিকল্প শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করার জন্য।
(iii) জাতীয় শিক্ষা প্রসার করার জন্য।

উত্তর: ব্যাখ্যা—(ii) সরকারি আদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কৃত ছাত্রদের বিকল্প শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করার জন্য।

(গ) অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ নিয়ে গান্ধিজির প্রচেষ্টাকে আম্বেদকর সমর্থন করেননি—

ব্যাখ্যা—

(i) গান্ধিজি মূলত মানবতার দিক থেকে দলিত সমস্যাকে উপলব্ধি করেছিলেন।
(ii) বিভিন্ন মন্দির কর্তৃপক্ষকে গান্ধিজি অস্পৃশ্যদের মন্দিরে প্রবেশের অনুমতি দিতে বলেন।
(iii) অস্পৃশ্যদের সার্বিক উন্নয়নে গান্ধিজি কোনো কর্মসূচি গ্রহণ করেননি।

উত্তর: ব্যাখ্যা—(i) গান্ধিজি মূলত মানবতার দিক থেকে দলিত সমস্যাকে উপলব্ধি করেছিলেন।

মানচিত্রে নিম্নলিখিত স্থানগুলি চিহ্নিত করো

(ক) কলকাতা
(খ) তমলুক
(গ) ওডকান্দি

বামস্তম্ভের সঙ্গে ডানস্তম্ভ মেলাও
বামস্তম্ভডানস্তম্ভ
(i) লীলা রায়(a) বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স
(ii) বিনয়-বাদল-দীনেশ(b) গুলামগিরি
(iii) প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার(c) দীপালি সংঘ
(iv) জ্যোতিবা ফুলে(d) চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন

উত্তর:

বামস্তম্ভডানস্তম্ভ
(i) লীলা রায়(c) দীপালি সংঘ
(ii) বিনয়-বাদল-দীনেশ(a) বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স
(iii) প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার(d) চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন
(iv) জ্যোতিবা ফুলে(b) গুলামগিরি
একটি বাক্যে উত্তর দাও 

ক. স্বদেশি আন্দোলনে মহিলাদের সমর্থন লাভ করার জন্য কাকে রূপক হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছিল?

উত্তর: স্বদেশি আন্দোলনে মহিলাদের সমর্থন লাভ করার জন্য মা লক্ষ্মীকে রূপক হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছিল।

খ. স্বদেশি যুগে গোপনে অস্ত্র সরবরাহ করতেন এমন একজন নারীর নাম লেখো।

উত্তর: স্বদেশি যুগে বীরভূমের দু’কড়িবালা দেবী গোপনে অস্ত্র সরবরাহ করার কাজে নিযুক্ত হন।

গ. ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় কার উদ্যোগে গোপনে কংগ্রেসের বেতার কেন্দ্র পরিচালিত হয়েছিল?

উত্তর: ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় উষা মেহতার উদ্যোগে গোপনে কংগ্রেসের বেতার কেন্দ্র পরিচালিত হয়েছিল।

ঘ. ‘দীপালি সংঘ’-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এমন একজন নারী বিপ্লবীর নাম লেখো ?

উত্তর: দীপালি সংঘ-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এমন একজন নারী বিপ্লবী হলেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার।

ঙ. বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দলের সঙ্গে কোন্ গোষ্ঠী যুক্ত হয়েছিল?

উত্তর: বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দলের সঙ্গে ঢাকার অনিল রায় ও লীলা রায়ের শ্রীসংঘ গোষ্ঠী যুক্ত হয়েছিল।

চ. কাকে হত্যা করার চেষ্টার অপরাধে বিপ্লবী বীণা দাসের কারাদণ্ড হয়েছিল?

উত্তর: গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসনকে হত্যা করার চেষ্টার অপরাধে বিপ্লবী বীণা দাসের কারাদণ্ড হয়েছিল।

জ. নারায়ণ গুরু কোন্ সম্প্রদায়ের মানুষের কল্যাণে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন?

উত্তর: নারায়ণ গুরু কেরলের এজভ সম্প্রদায়ের দলিত মানুষের কল্যাণে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন।

সংক্ষিপ্ত উত্তরধর্মী প্রশ্

ক. বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে সরলাদেবী চৌধুরানি কী ভূমিকা পালন করেছিলেন?

উত্তর: স্বদেশি আন্দোলনের সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাগনি সরলাদেবী চৌধুরানী উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। তিনি ‘ভারতী’ পত্রিকায় বিভিন্ন প্রবন্ধ প্রকাশের মাধ্যমে নারীশক্তিকে উজ্জীবিত করে তোলেন। সরলাদেবী মেয়েদের স্বাস্থ্যের উন্নতির দিকে নজর দেওয়ার জন্য নিজের বাড়িতে ব্যায়ামাগার স্থাপন করেন। এ ছাড়া তিনি বীরাষ্টমী উৎসব, প্রতাপাদিত্য ব্রত, উদয়াদিত্য ব্রত ইত্যাদি প্রচলন করেন এবং এই উৎসবগুলিতে বাঙালি যুবকদের লাঠি খেলা, কুস্তি, তরবারি খেলা, শরীরচর্চা ইত্যাদির প্রতি উৎসাহদান করতেন।

খ. স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে ননীবালা দেবী কেন স্মরণীয় হয়ে আছেন?

উত্তর: বিপ্লবী অমরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মেজো পিসিমা ননীবালা দেবী বিপ্লবীদের আশ্রয় দেওয়ার অপরাধে গ্রেফতার হন। নির্যাতন চালিয়েও তাঁর কাছ থেকে পুলিশ কোনো গোপন তথ্য আদায় করতে পারেনি। ননীবালা দেবী ভারতের প্রথম ও একমাত্র মহিলা যাঁকে ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে ৩নং ধারায় বিনা বিচারে আটক করা হয়, এই কারণে তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন।

গ. আইন অমান্য আন্দোলনে বাংলার মহিলারা কী কী কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন?

উত্তর: আইন অমান্য আন্দোলনে বাংলার মহিলারা বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন। মেদিনীপুরের ঘাটাল, কাঁথি, তমলুক প্রভৃতি স্থানের মহিলারা পুলিশের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে লবণ প্রস্তুত ও বিক্রি করেন। এছাড়া বাংলার মহিলারা এই সময় নারীশিক্ষার প্রসার, গ্রামীণ শিল্পের বিকাশ, অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা ইত্যাদি বিভিন্ন কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত হন।

ঘ. মাতঙ্গিনী হাজরা ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছেন কেন?

উত্তর: ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অসীম বীরত্ব ও সাহসিকতা প্রদর্শনের জন্য মেদিনীপুরের মাতঙ্গিনী হাজরা ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছেন। বীরাঙ্গনা মাতঙ্গিনী হাজরার আত্মবলিদানের কাহিনি আজও মানুষের মনে রোমাঞ্চ সৃষ্টি করে। তিনি মেদিনীপুরের তমলুকে একটি থানা দখল অভিযানে নেতৃত্ব দেন এবং পুলিশের গুলিতে জখম হন। শেষনিঃশ্বাস ত্যাগের আগে পর্যন্ত তিনি জাতীয় পতাকা বুকে আগলে রাখেন, তাই তিনি ইতিহাসে অমর।

ঙ. বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছাত্রদের বিরুদ্ধে ইংরেজ সরকার কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন?

উত্তর: বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছাত্রদের বিরুদ্ধে ইংরেজ সরকার কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। ছাত্র সমাজের ব্যাপক যোগদানে ভীত হয়ে সরকার দমননীতি প্রয়োগ করে। প্রাদেশিক সরকারের মুখ্যসচিব আর. ডব্লিউ কার্লাইল এক গোপন সার্কুলার জারি করে (১০ অক্টোবর ১৯০৫) আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছাত্রদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে বলেন। শিক্ষা অধিকর্তা পেডলার কলকাতার কলেজগুলির অধ্যক্ষদের পিকেটিং-এর সঙ্গে যুক্ত ছাত্রদের বহিষ্কার করার আদেশ দেন এবং সরকারি স্কুল ও কলেজ থেকে বহু ছাত্রকে বহিষ্কার করা হয়।

চ. ইতিহাসে কোন্ ঘটনা ‘অলিন্দ যুদ্ধ’ নামে পরিচিত?

উত্তর: ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ৮ ডিসেম্বর বিনয় বসু ও তাঁর দুই বিপ্লবী বন্ধু বাদল গুপ্ত ও দীনেশ গুপ্ত রাইটার্স বিল্ডিং অভিযান করে কারা বিভাগের ইন্সপেক্টর জেনারেল সিম্পসন ও অন্য এক উচ্চপদস্থ কর্মচারী ক্রেগকে গুলি করে হত্যা করেন। এরপর পুলিশ রাইটার্স বিল্ডিং ঘিরে ফেললে পুলিশের সাথে এই তিন তরুণের যে প্রচণ্ড লড়াই হয়, ইতিহাসে সেই ঘটনাই ‘অলিন্দ যুদ্ধ’ নামে পরিচিত।

ছ. ‘রশিদ আলি দিবস’ কী?

উত্তর: ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১০ ফেব্রুয়ারি দিল্লির লালকেল্লাতে আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতা ক্যাপ্টেন রশিদকে ৭ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। এর প্রতিবাদে ১১ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় ছাত্র সমাজ গণপ্রতিরোধে উত্তাল হয়ে ওঠে এবং পরদিন ১২ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় ‘রশিদ আলি দিবস’ পালিত হয়।

জ. ‘সেলফ রেসপেক্ট আন্দোলন’ বলতে কী বোঝো?

উত্তর: ‘সেলফ রেসপেক্ট আন্দোলন’ হল ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেস ত্যাগ করার পর ই. ভি. রামস্বামী নায়কার দ্বারা নিম্নবর্ণের মানুষের স্বার্থে গড়ে তোলা একটি আন্দোলন। এই আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি হিন্দুধর্ম ও ব্রাহ্মণতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান এবং মানুষের সমতা ও সম-অধিকার দাবি করেন। এই আন্দোলন ক্রমশ উগ্ররূপ ধারণ করে এবং এর অংশ হিসেবে ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের বর্জন ও প্রকাশ্যে মনুস্মৃতি পোড়ানো হয়।

বিশ্লেষণধর্মী প্রশ্

ক. স্বদেশি আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণের চরিত্র ছিল মূলত ঘরোয়া-তুমি কি এই মন্তব্যকে সমর্থন করো? উত্তরের সপক্ষে যুক্তি দাও।

উত্তর: স্বদেশি আন্দোলনে নারী সমাজ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সক্রিয় অংশগ্রহণ না করে সহযোগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। নারীদের অংশগ্রহণের চেহারা ছিল মূলত ঘরোয়া। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশি আন্দোলনের সময় বিদেশি বস্ত্র বর্জন ও পোড়ানো, দেশি কাপড়ের প্রচলন, অরন্ধন দিবস পালন প্রভৃতি কর্মসূচিতে নারীরা যোগদান করেন। এ ছাড়া বিপ্লবীদের আশ্রয়দান, গোপনে সংবাদ ও অস্ত্র সরবরাহ ইত্যাদির মাধ্যমে তাঁরা বৃহৎ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হন। তবে, আন্দোলনে সহযোগীর ভূমিকার পাশাপাশি কিছু ক্ষেত্রে নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণেরও দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। যেমন সরলাদেবী চৌধুরানী উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন, ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রবন্ধ প্রকাশ ও ব্যায়ামাগার স্থাপন করেন। তাই বলা যায়, অংশগ্রহণ মূলত ঘরোয়া ও সহযোগীর ভূমিকায় হলেও সক্রিয় অংশগ্রহণের উদাহরণও ছিল।

খ. আইন অমান্য আন্দোলনে নারী সমাজের যোগদান কীরূপ ছিল?

উত্তর: ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের আইন অমান্য আন্দোলনে মহিলারা অনেক বেশি মাত্রায় অংশগ্রহণ করেন। গান্ধিজির আহ্বানে দেশের সব প্রান্তের হাজার হাজার নারী আন্দোলনের ডাকে সাড়া দেন। লবণ আইন ভাঙা থেকে শুরু করে বিলিতি কাপড় ও মদের দোকানের সামনে পিকেটিং – এই সমস্ত কর্মসূচিতে তারা সক্রিয়ভাবে যোগদান করেন। বম্বে, এলাহাবাদ, লাহোর, দিল্লি প্রভৃতি শহরের মহিলারা প্রকাশ্যে বিক্ষোভ জানান। বিভিন্ন বিক্ষোভ সমাবেশে সম্ভ্রান্ত পরিবারের মহিলারা বিপুল সংখ্যায় যোগদান করেন। তাদের এই স্বতঃস্ফূর্ত যোগদানে শুধুমাত্র ইংরেজ সরকারই নয়, রক্ষণশীল পুরুষ সমাজও স্তম্ভিত হয়ে যায়। এমনকি এই আন্দোলনে কৃষক পরিবারের নারীদের সক্রিয় যোগদানও উল্লেখ করার মতো। মেদিনীপুরের ঘাটাল, কাঁথি, তমলুক প্রভৃতি স্থানের মহিলারা পুলিশের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে লবণ প্রস্তুত ও বিক্রি করেন। বাংলার মহিলারা এই সময় নারীশিক্ষার প্রসার, গ্রামীণ শিল্পের বিকাশ, অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা ইত্যাদি বিভিন্ন কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত হন। সরোজিনী নাইডু, কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায়, বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত, কমলা নেহরু প্রমুখ বিশিষ্ট মহিলারা এই আন্দোলনে যোগদান করেছিলেন এবং তাঁদের অংশগ্রহণ ভারতীয় নারী সমাজকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করে।

গ. টীকা লেখো-প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার।

উত্তর: প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার (১৯১১-১৯৩২ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন বাংলার অন্যতম নারী বিপ্লবী ও শহীদ। তিনি দীপালি সংঘের একজন সভ্যা ছিলেন এবং সেখান থেকেই বিপ্লবের আদর্শে অনুপ্রাণিত হন। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে তিনি বিপ্লবী নেতা সূর্য সেনের সংস্পর্শে আসেন এবং চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের নেতা সূর্য সেনের সহকারিণী হিসেবে কাজ করেন। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ২৪শে সেপ্টেম্বর প্রীতিলতার নেতৃত্বে এক বিদ্রোহী দল পাহাড়তলি ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ করে। পুলিশের গুলিতে অনেক বিদ্রোহী আহত হন। পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়ার আগে প্রীতিলতা বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেন। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি নিজের কর্তব্যবোধ সম্পর্কে সচেতন ছিলেন এবং মৃত্যুর আগে নিজের সহযোদ্ধাদের নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। প্রীতিলতা শহিদ হন এবং তাঁর আত্মত্যাগ হাজার হাজার তরুণ-তরুণীকে বিপ্লববাদের আদর্শে অনুপ্রাণিত করে তোলে।

ঘ. ‘বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো’-মন্তব্যটির যথার্থতা বিচার করো।

উত্তর: বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদের উপস্থিতি সত্যিই চোখে পড়ার মতো ছিল। রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছাত্রদেরকে এই আন্দোলনের ‘স্বনিয়োজিত প্রচারক’ বলে অভিহিত করেন। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে রিপন কলেজে ছাত্র সমাবেশের আয়োজন করা হয় যেখানে ‘বয়কট’ আদর্শ গৃহীত হয়। কলকাতার সব কলেজকে একত্রিত করে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় এবং বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়। ছাত্রদের একটি কেন্দ্রীয় সমিতিও গঠিত হয়। ৭ই আগস্ট কলকাতার টাউন হলে বিশাল জনসমাবেশে ছাত্ররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। প্রায় ৫০০০ ছাত্র কলেজ স্কোয়ারে একত্রিত হয়ে ‘সংযুক্ত বাংলা’ ও ‘বন্দে মাতরম্’ ধ্বনিতে আকাশ বাতাস আলোড়িত করে শোভাযাত্রা করে। ছাত্ররা শহরের দোকানে পিকেটিং করে এবং বিলাতি পণ্য বর্জনের জন্য প্রচার চালায়। ছাত্র সমাজের এই ব্যাপক যোগদানে ইংরেজ সরকার ভীত হয়ে পড়ে এবং তাদের উপর দমননীতি প্রয়োগ করে, যা অ্যান্টি-সার্কুলার সোসাইটি গঠনের পটভূমি তৈরি করে। সুতরাং, মন্তব্যটি যথার্থ।

ঙ. টীকা লেখো-বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স।

উত্তর: আইন অমান্য আন্দোলনের সময় বাংলায় বৈপ্লবিক তৎপরতা বৃদ্ধি পায়, যার মূলে ছিল বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স গোষ্ঠী। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার কংগ্রেস অধিবেশনের সময় সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে গঠিত স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর কিছু সদস্যকে নিয়ে হেমচন্দ্র ঘোষ ঢাকায় বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দল গঠন করেন। এর সঙ্গে ঢাকার অনিল রায় ও লীলা রায়ের শ্রীসংঘ গোষ্ঠী যুক্ত হয়। বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দলের কার্যকলাপ ছিল চমকপ্রদ ও দুঃসাহসিক। এই দলের কর্মী বিনয় বসু, বাদল গুপ্ত ও দীনেশ গুপ্ত রাইটার্স বিল্ডিং অভিযান (অলিন্দ যুদ্ধ) পরিচালনা করেন এবং কারা বিভাগের ইন্সপেক্টর জেনারেল সিম্পসনকে হত্যা করেন। এছাড়া মেদিনীপুর জেলায় এই গোষ্ঠীর সদস্যরা তিনজন শ্বেতাঙ্গ ম্যাজিস্ট্রেটকে পরপর হত্যা করেন। এই দলের অবদান বাংলার বিপ্লববাদের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে।

চ. আজাদ হিন্দ বাহিনীর বন্দিদের বিচারের বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজ কী ভূমিকা গ্রহণ করেছিল।

উত্তর: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আজাদ হিন্দ বাহিনীর বন্দিদের বিচারকে কেন্দ্র করে ভারতের ছাত্র সমাজ ব্রিটিশ বিরোধী বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বন্দি তিন সেনাপতি শাহনওয়াজ খান, গুরুবক্স সিং ধীলন ও প্রেম সেহগালের মুক্তির দাবিতে ছাত্ররা সোচ্চার হয়ে ওঠে। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ২১ নভেম্বর বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্র কংগ্রেস, ফরওয়ার্ড ব্লকের ছাত্র সংগঠন, কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র সংগঠন ‘ছাত্র ফেডারেশন’ ও ইসলামিয়া কলেজের ছাত্ররা একত্রিত হয়ে মিছিল করে ডালহৌসি স্কোয়ারে যাওয়ার চেষ্টা করে। কলকাতায় বিক্ষোভরত ছাত্রদের মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে ছাত্র রামেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় নিহত হন। এর প্রতিবাদে পরের দিন কলকাতায় সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয় এবং জনজীবন অচল হয়ে পড়ে। ছাত্রদের এই তীব্র আন্দোলনের ফলে ব্রিটিশ সরকার ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১ জানুয়ারি ওই তিন সেনানায়ককে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।

ছ. অস্পৃশ্যতা ও দলিত আন্দোলন সম্পর্কে গান্ধিজি কী অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন?

উত্তর: গান্ধিজিই প্রথম অস্পৃশ্যতার বিষয়টিকে জাতীয় স্তরে জনসমক্ষে নিয়ে আসেন। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তাবে তিনি অস্পৃশ্যতা দূরীকরণের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি বর্ণপ্রথার মধ্যে প্রবেশ করা কুপ্রথাগুলির বিরোধিতা করেন এবং অস্পৃশ্যতাকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বলে মন্তব্য করেন। কংগ্রেস অস্পৃশ্যদের অবস্থার উন্নতির জন্য ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে একটি কমিটি নিয়োগ করে। গান্ধিজি বহু মন্দির কর্তৃপক্ষকে অস্পৃশ্যদের মন্দিরে প্রবেশের অনুমতি দিতে বলেন এবং দলিতদের ‘হরিজন’ (ঈশ্বরের সন্তান) নামে অভিহিত করেন। ১৯৩২ সালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ‘সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা’ নীতিতে দলিতদের জন্য পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর ব্যবস্থার বিরুদ্ধে গান্ধিজি জেলে অনশন শুরু করেন, যার ফলে পুণা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এরপর তিনি পুরোপুরি হরিজন আন্দোলনের উপর মনোনিবেশ করেন, যার উদ্দেশ্য ছিল অস্পৃশ্যতা দূর করা। এই উদ্দেশ্যে তিনি ‘হরিজন’ পত্রিকা প্রকাশ করেন এবং দেশব্যাপী ‘হরিজন ভ্রমণ’-এ বের হন। গান্ধিজি মূলত মানবতার দিক থেকে দলিত সমস্যাকে উপলব্ধি করেছিলেন এবং তাদের সামাজিক অবস্থার উন্নতির জন্য সচেষ্ট ছিলেন।

জ. দলিত আন্দোলন বিষয়ে গান্ধি-আম্বেদকর বিতর্ক নিয়ে একটি টীকা লেখো।

উত্তর: দলিত আন্দোলন এবং অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ বিষয়ে গান্ধিজি ও ড. বি. আর. আম্বেদকরের মধ্যে সুস্পষ্ট মতপার্থক্য ছিল। গান্ধিজির হরিজন আন্দোলন ও তাঁর কর্মসূচি দলিত নেতা আম্বেদকর সহ অনেককে সন্তুষ্ট করতে পারেনি, কারণ দলিতরা নিজেদের কংগ্রেসের ছত্রছায়ায় বা বর্ণহিন্দুদের অধীনে রাখতে চায়নি। আম্বেদকর দলিতদের জন্য পৃথক রাজনৈতিক সংগঠন (যেমন সর্বভারতীয় নিপীড়িত শ্রেণির কংগ্রেস, ইন্ডিপেন্ডেন্ট লেবার পার্টি) গড়ে তোলেন এবং কংগ্রেসের সরাসরি বিরোধিতা করেন। প্রধান বিতর্ক দেখা দেয় রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ে। আম্বেদকর ১৯২৮ সাল থেকে দলিতদের জন্য পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর দাবি করেন, যা তিনি গোলটেবিল বৈঠকেও তুলে ধরেন। গান্ধিজি এর তীব্র বিরোধিতা করেন কারণ তিনি মনে করতেন এটি হিন্দু সমাজকে বিভক্ত করবে। এই মতপার্থক্যের চূড়ান্ত পর্যায় দেখা যায় ১৯৩২ সালের সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা ঘোষণাকে কেন্দ্র করে, যার বিরুদ্ধে গান্ধিজির অনশনের ফলে পুণা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। আম্বেদকর গান্ধিজিকে লেখা চিঠিতে জানান যে, মন্দিরে প্রবেশ বা সহভোজনের মতো বিষয়ে তাঁর উৎসাহ নেই, তিনি চান দলিতদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক দুরবস্থার সম্পূর্ণ অবসান। গান্ধিজি যেখানে মূলত মানবতার দৃষ্টিকোণ থেকে এবং হিন্দুধর্মের অভ্যন্তরীণ সংস্কারের মাধ্যমে অস্পৃশ্যতা দূর করতে চেয়েছিলেন, সেখানে আম্বেদকরের লক্ষ্য ছিল শিক্ষা, চাকরি, রাজনৈতিক ক্ষমতা ও পৃথক পরিচিতির মাধ্যমে দলিতদের সার্বিক অধিকার সুনিশ্চিত করা। এই মতপার্থক্যের জেরেই আম্বেদকর শেষ পর্যন্ত হিন্দুধর্ম ত্যাগ করার কথাও ঘোষণা করেন।

ব্যাখ্যাধর্মী প্রশ্ন

ক. স্বাধীনতা আন্দোলনের বিভিন্ন পর্বে নারী সমাজের ভূমিকা বিষয়ে একটি তুলনামূলক আলোচনা করো।

উত্তর: বিশ শতকের ভারতে জাতীয় আন্দোলনে নারী সমাজের ভূমিকা বিভিন্ন পর্বে ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। উনিশ শতকের নারীশিক্ষা প্রসারের ফলে নারী সমাজ নিজেদের অবস্থান ও পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন হয় এবং জাতীয়তাবাদী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আন্দোলনে যোগদান করে।

স্বদেশি আন্দোলন পর্বে (১৯০৫) নারী সমাজ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সরাসরি সক্রিয় অংশগ্রহণ না করে সহযোগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। তাদের অংশগ্রহণ মূলত ঘরোয়া প্রকৃতির ছিল, যেমন বিদেশি বস্ত্র বর্জন ও পোড়ানো, দেশি কাপড়ের প্রচলন, অরন্ধন দিবস পালন। তবে বিপ্লবীদের আশ্রয়দান, গোপনে সংবাদ ও অস্ত্র সরবরাহের মাধ্যমেও তারা যুক্ত হন। সরলাদেবী চৌধুরানী ‘ভারতী’ পত্রিকায় লেখার মাধ্যমে ও বীরাষ্টমী উৎসব, প্রতাপাদিত্য ব্রত ইত্যাদির মাধ্যমে নারীশক্তিকে উজ্জীবিত করেন। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর ‘বঙ্গলক্ষ্মীর ব্রতকথা’ নারীদের উদ্বুদ্ধ করে এবং ‘বঙ্গলক্ষ্মী’ উপাধি দানের প্রথা চালু হয়। বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হওয়ার দিন বহু নারী অরন্ধন পালন করেন। কুমুদিনী মিত্র, লীলাবতী মিত্র, মনোরমা বসু, সৌদামিনী দেবী, সরোজিনী দেবী, দু’কড়িবালা দেবী প্রমুখ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেন। ননীবালা দেবী বিপ্লবীদের আশ্রয় দেওয়ার অপরাধে প্রথম মহিলা হিসাবে বিনা বিচারে আটক হন। ভগিনী নিবেদিতা ও অ্যানি বেসান্তও নারীদের অনুপ্রাণিত করেন।

অহিংস অসহযোগ আন্দোলন পর্বে (১৯২০-২২) গান্ধিজির আহ্বানে নারী সমাজের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পায়। যদিও গান্ধিজি প্রাথমিকভাবে মহিলাদের সীমিত কর্মসূচিতে (বিদেশি দ্রব্য বয়কট, স্বদেশি দ্রব্য গ্রহণ) অংশগ্রহণের নির্দেশ দেন, নারীরা আরও সক্রিয়ভাবে পিকেটিং-এ অংশগ্রহণ করেন। ১৯২১-এ প্রিন্স অফ ওয়েলসের ভারত ভ্রমণের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মহিলা বিক্ষোভ দেখান। বাসন্তীদেবী, ঊর্মিলাদেবী, সুনীতিদেবী প্রমুখ গ্রেফতার হন। ‘কর্মমন্দির’, ‘নারী সত্যাগ্রহ সমিতি’র মাধ্যমে নারীরা সভা-সমিতি, মিটিং মিছিলে অংশ নেন।

আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে (১৯৩০) মহিলাদের অংশগ্রহণ আরও ব্যাপক হয়। গান্ধিজির বিশেষ আহ্বানে সাড়া দিয়ে হাজার হাজার নারী লবণ আইন ভঙ্গ, বিলিতি কাপড় ও মদের দোকানের সামনে পিকেটিং ইত্যাদি কর্মসূচিতে সক্রিয়ভাবে যোগ দেন। বম্বে, এলাহাবাদ, লাহোর, দিল্লির মতো শহরে মহিলারা প্রকাশ্যে বিক্ষোভ দেখান। সম্ভ্রান্ত ও কৃষক পরিবারের নারীদের স্বতঃস্ফূর্ত যোগদান রক্ষণশীল সমাজকেও স্তম্ভিত করে। মেদিনীপুরের মহিলারা লবণ প্রস্তুত ও বিক্রি করেন। সরোজিনী নাইডু, কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায়, বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত, কমলা নেহরু প্রমুখ নেতৃত্ব দেন।

ভারত ছাড়ো আন্দোলন পর্বে (১৯৪২) নারীর ভূমিকা আরও স্পষ্ট হয়। স্কুল-কলেজের ছাত্রীরাও অংশ নেয়। অরুণা আসফ আলি ও সুচেতা কৃপালিনী মেয়েদের সংগঠিত করেন ও গোপনে আন্দোলন চালান। অরুণা আসফ আলি বোম্বাই-এর আগস্ট-ক্রান্তি ময়দানে পতাকা তোলেন। উষা মেহতা গোপনে বেতার কেন্দ্র পরিচালনা করেন। মেদিনীপুরের মাতঙ্গিনী হাজরা থানা দখল অভিযানে নেতৃত্ব দিয়ে পুলিশের গুলিতে শহিদ হন। বীরভূমে নন্দিতা কৃপালিনী, রানি চন্দ্র, এলা দত্ত প্রমুখ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন।

এছাড়াও, জাতীয় কংগ্রেসে সরোজিনী নাইডু প্রথম ভারতীয় মহিলা সভাপতি হন এবং মুথুলক্ষ্মী রেড্ডি প্রথম মহিলা আইনসভার সদস্যা হিসাবে মহিলাদের ভোটাধিকার ও দেবদাসী প্রথার বিলোপসাধনে কাজ করেন। সুভাষচন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজে লক্ষ্মী স্বামীনাথনের নেতৃত্বে ‘ঝাঁসির রানি ব্রিগেড’ নামে একটি নারীবাহিনী গঠিত হয়, যা যুদ্ধক্ষেত্রে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের অংশগ্রহণের এক বড়ো নিদর্শন।

সুতরাং দেখা যায়, স্বদেশি আন্দোলনের সহযোগী ভূমিকা থেকে শুরু করে ভারত ছাড়ো আন্দোলন ও আজাদ হিন্দ ফৌজে সক্রিয় অংশগ্রহণ পর্যন্ত বিভিন্ন পর্বে নারী সমাজের ভূমিকা ক্রমশ প্রত্যক্ষ ও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।

খ. সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে নারীদের যোগদান সম্পর্কে লেখো। বৈপ্লবিক নারী জাগরণে ‘দীপালি সংঘ’ কী ভূমিকা পালন করেছিল? ৫+৩

উত্তর: গান্ধিজির অহিংস আন্দোলনের সমান্তরালে ভারতে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের ক্ষেত্রও প্রস্তুত হয়েছিল, এবং এই আন্দোলনে বাংলার শিক্ষিত মহিলাদের সক্রিয়তা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। শুধুমাত্র সহযোগীর ভূমিকায় আবদ্ধ না থেকে তারা সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়।

ভগিনী নিবেদিতা নারী সমাজকে বিপ্লববাদে অনুপ্রাণিত করেছিলেন এবং বাংলার অনুশীলন সমিতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। বহু নারী বিপ্লবী আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সশস্ত্র সংগ্রামে যোগদান করেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্ত, শান্তি ঘোষ, সুনীতি চৌধুরি, বীণা দাশ প্রমুখ। স্বদেশি যুগে ননীবালা দেবী বিপ্লবীদের আশ্রয় দেওয়ার অপরাধে গ্রেফতার হন এবং ভারতের প্রথম ও একমাত্র মহিলা হিসাবে ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে ৩নং ধারায় বিনা বিচারে আটক হন।

চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের নেতা সূর্য সেনের সহকারিণী ছিলেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে তাঁর নেতৃত্বে এক বিদ্রোহী দল পাহাড়তলি ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ করে। পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়ার আগে তিনি বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেন। কল্পনা দত্তও বিপ্লবী দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, গোপন কাগজপত্র ও অস্ত্রশস্ত্র রাখতেন এবং জেলে বন্দি বিপ্লবীদের মুক্ত করার পরিকল্পনাতেও যুক্ত ছিলেন। পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে তিনি মাস্টারদা ও তারকেশ্বর দস্তিদারের সঙ্গে যোগ দেন এবং পরে বিচারে তাঁর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে কলেজ ছাত্রী বীণা দাস কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসনকে গুলি করেন, যার জন্য তাঁর নয় বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়। শান্তি ঘোষ ও সুনীতি চৌধুরিও বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন।

দীপালি সংঘের ভূমিকা:

এই বৈপ্লবিক নারী জাগরণের স্থপতি ছিলেন লীলা রায় (পরে নাগ)। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় তিনি ‘দীপালি সংঘ’ প্রতিষ্ঠা করেন। মাত্র বারো জন মহিলা সহযোগী নিয়ে তিনি এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য ছিল মেয়েদের বিপ্লবী আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত করা। ভারতের মুক্তিযুদ্ধের উপযুক্ত যোদ্ধা তৈরি করার উদ্দেশ্যে মেয়েদের জন্য নানা কর্মসূচি গৃহীত হয়, যেমন লাঠিখেলা, শরীরচর্চা ও অস্ত্র চালানোর শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হয়। এই ধরনের কর্মসূচি মহিলাদের সাহস ও শক্তিবৃদ্ধির সহায়ক হয়ে ওঠে। নারী প্রগতি আন্দোলনের পুরোধা লীলা রায় তরুণীদের বৈপ্লবিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ করে তোলেন। সংগঠন নির্মাণ, অস্ত্রশস্ত্র জোগাড়, বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে তিনি মহিলাদের প্রশিক্ষণ দেন। দীপালি সংঘ হয়ে ওঠে মহিলা বিপ্লবীদের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারও দীপালি সংঘের একজন সভ্যা ছিলেন এবং সেখান থেকেই তিনি বিপ্লবের আদর্শে অনুপ্রাণিত হন।

গ. স্বাধীনতা আন্দোলনের বিভিন্ন পর্বে ছাত্র সমাজের অবস্থান সম্পর্কে একটি তুলনামূলক আলোচনা করো।

উত্তর: ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে ছাত্র সমাজের যোগদান এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বিভিন্ন পর্বে তাদের ভূমিকা ও অবস্থান পরিবর্তনশীল ছিল।

বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলন পর্বে (১৯০৫) ছাত্রদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথের মতে, তারা ছিল এই আন্দোলনের ‘স্বনিয়োজিত প্রচারক’। তারা রিপন কলেজে শপথ গ্রহণ করে, কলকাতার টাউন হলে ও কলেজ স্কোয়ারে বিশাল সমাবেশে যোগ দেয়, দোকানে পিকেটিং করে এবং ‘বন্দে মাতরম্’ ধ্বনিতে শোভাযাত্রা করে। ছাত্রদের এই ব্যাপক যোগদানে ভীত হয়ে সরকার কার্লাইল সার্কুলার জারি করে আন্দোলনরত ছাত্রদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়। এর প্রতিবাদে শচীন্দ্রপ্রসাদ বসুর নেতৃত্বে অ্যান্টি-সার্কুলার সোসাইটি গঠিত হয়, যা বহিষ্কৃত ছাত্রদের বিকল্প শিক্ষার ব্যবস্থা করে।

অহিংস অসহযোগ আন্দোলন পর্বে (১৯২০-২২) ছাত্র সমাজ পুনরায় উদ্দীপিত হয়। কর্মসূচির অংশ হিসাবে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বর্জন করে বহু ছাত্র জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যোগ দেয়। বাংলায় প্রায় ১৯০টি জাতীয় বিদ্যালয় ও কলেজ স্থাপিত হয় এবং প্রায় পনেরো হাজার শিক্ষার্থী সেখানে পড়াশোনা করত। স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা অসহযোগ আন্দোলনের ভলান্টিয়ার হিসাবে যোগদান করেছিল।

আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে (১৯৩০) ছাত্রদের অংশগ্রহণ অসহযোগ আন্দোলনের মতো ব্যাপক ছিল না। গান্ধিজি ছাত্রদের স্কুল-কলেজ বয়কটকে অবাস্তব বলেন এবং বিকল্প জাতীয় বিদ্যালয়ের ব্যবস্থা না করেই বিদ্যালয় বয়কটের পক্ষে সমর্থন জানাননি। ফলে বিক্ষিপ্ত কিছু স্থান ছাড়া এই পর্বে ছাত্রসমাজের উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ চোখে পড়ে না।

ভারত ছাড়ো আন্দোলন পর্বে (১৯৪২) ছাত্র সমাজ স্বতঃস্ফূর্তভাবে গণ-আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে শহরের ছাত্রসমাজ মুখ্য ভূমিকা পালন করে। ধর্মঘট, বয়কট ও পিকেটিং-এর মাধ্যমে তারা আন্দোলনকে জোরদার করে তোলে। ছাত্র-যুবদের হাত ধরেই আন্দোলন গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ‘আজাদ’ ট্রেন লুঠ করে কৃষকদের অনুপ্রাণিত করে। পাটনার মহাকরণে জাতীয় পতাকা তুলতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে সাতজন ছাত্র মারা যায়। এরপর আন্দোলন উগ্র রূপ নেয়, ছাত্ররা যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেয়। সরকার নিষ্ঠুর দমন-পীড়ন চালালেও ছাত্রসমাজের স্বতঃস্ফূর্ত যোগদান আন্দোলনকে গতি দিয়েছিল।

যুদ্ধোত্তর পর্বে ছাত্রসমাজ পুনরায় ব্রিটিশ বিরোধী অভ্যুত্থানে জেগে ওঠে। আজাদ হিন্দ বাহিনীর বন্দিদের বিচারকে কেন্দ্র করে ১৯৪৫-এর নভেম্বরে কলকাতায় ছাত্রসমাজ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্র কংগ্রেস, ফরওয়ার্ড ব্লকের ছাত্রসংগঠন, ছাত্র ফেডারেশন ও ইসলামিয়া কলেজের ছাত্ররা ডালহৌসি স্কোয়ারে মিছিল করলে পুলিশ গুলি চালায়, ছাত্র রামেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় নিহত হন। এই আন্দোলনের ফলে সরকার বন্দি তিন সেনাপতিকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ১৯৪৬-এর ফেব্রুয়ারিতে ক্যাপ্টেন রশিদ আলির কারাদণ্ডের প্রতিবাদে ছাত্রসমাজ পুনরায় উত্তাল হয় (‘রশিদ আলি দিবস’)। হিন্দু-মুসলিম ছাত্ররা একত্রে বিশাল বিক্ষোভ মিছিল করে, যা গণ-আন্দোলনের স্রোতে সাম্প্রদায়িক বিভেদ দূর করে দেয় এবং এই বিক্ষোভ নৌবাহিনী পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।

সুতরাং, দেখা যায় যে স্বাধীনতা আন্দোলনের বিভিন্ন পর্বে ছাত্র সমাজের ভূমিকা কখনও অত্যন্ত সক্রিয় (বঙ্গভঙ্গ বিরোধী, ভারত ছাড়ো, যুদ্ধোত্তর পর্ব), কখনও তুলনামূলকভাবে কম (আইন অমান্য), কিন্তু সামগ্রিকভাবে তাদের অংশগ্রহণ ভারতের মুক্তি সংগ্রামে এক গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসাবে কাজ করেছে।

ঘ. সশস্ত্র আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণ কীরূপ ছিল? তাদের অন্তর্ভুক্তি সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনকে কতটা প্রভাবিত করেছিল?

উত্তর: বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের সময় থেকেই ছাত্র-যুবদের মধ্যে সংগ্রামী বিপ্লববাদের আদর্শ প্রচারিত হয়। বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ তরুণ ছাত্র সমাজকে বিপ্লববাদে দীক্ষিত করেন। বাংলার বিপ্লবীরা, যাদের মধ্যে অনেকেই ছাত্র ছিল, গুপ্ত হত্যায় লিপ্ত হন। মুরারীপুকুরের বাগান বাড়িতে বোমা তৈরির গুপ্ত কারখানা গড়ে তোলার সঙ্গেও ছাত্ররা যুক্ত ছিল। কুখ্যাত বিচারপতি কিংসফোর্ডকে হত্যা করার চেষ্টার অপরাধে ক্ষুদিরাম বসুর (যিনি ছাত্র ছিলেন) ফাঁসি হয়। এই ঘটনায় যুক্ত আরেক তরুণ প্রফুল্ল চাকী পুলিশের হাতে ধরা পড়ার আগে আত্মহত্যা করেন। এই দুই তরুণ ছাত্রের আত্মত্যাগ ভারতবাসীর মনে দেশপ্রেমের বন্যা বইয়ে দেয় এবং বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাদের মৃত্যু উপলক্ষ্যে ছুটি ঘোষণা করা হয়। আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলায় দণ্ডিত বিপ্লবীদের মধ্যেও অনেকে ছাত্র ছিল।

আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হওয়ার আগেও ছাত্র সমাজ সক্রিয় জাতীয়তাবাদী কার্যকলাপে লিপ্ত হয়। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে গঠিত স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর দুজন ঘনিষ্ঠ স্বেচ্ছাসেবক ছিলেন বঙ্গবাসী কলেজের ছাত্র যতীন দাস ও প্রমোদ ঘোষাল। যতীন দাস সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে পাঞ্জাবের বিপ্লবী ভগৎ সিং (যিনি ছাত্রাবস্থাতেই বিপ্লবী কার্যকলাপে যুক্ত হন) লালা লাজপৎ রায়ের হত্যাকারী পুলিশ কমিশনার সান্ডার্সকে গুলি করেন। সান্ডার্স হত্যার পর পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে এবং সরকারকে সতর্ক করতে ১৯২৯-এর ৮ এপ্রিল ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্ত দিল্লির সংসদ ভবনে বোমা নিক্ষেপ করেন। এরপর লাহোর ষড়যন্ত্র মামলায় ধৃত বিপ্লবীদের বেশির ভাগই ছিলেন ছাত্র সমাজের প্রতিনিধি। এই মামলায় অভিযুক্ত বিপ্লবীরা যুদ্ধবন্দি হিসাবে বিবেচিত হওয়ার দাবিতে জেলের মধ্যে অনশন শুরু করেন। বিপ্লবী যতীন দাস ৬৪ দিন অনশন করে শহিদ হন। ভগৎ সিং, শুকদেব ও রাজগুরুর ফাঁসি হয়, যা সারা দেশকে প্রতিবাদে উত্তাল করে তোলে।

বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স গোষ্ঠী, যা আইন অমান্য আন্দোলনের সময় বাংলায় বৈপ্লবিক তৎপরতা তুঙ্গে তুলেছিল, তার কার্যকলাপ ছিল চমকপ্রদ ও দুঃসাহসিক। এর সদস্যরা মূলত ছাত্র ও যুবক ছিলেন। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে এই দলের সদস্য বিনয়কৃষ্ণ বসু, বাদল গুপ্ত ও দীনেশ গুপ্ত রাইটার্স বিল্ডিং অভিযান (‘অলিন্দ যুদ্ধ’) চালান, যা ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। এই ঘটনায় বাদল গুপ্ত আত্মহত্যা করেন, বিনয় বসু হাসপাতালে মারা যান এবং দীনেশের ফাঁসি হয়। মেদিনীপুরে এই গোষ্ঠীর সক্রিয় সদস্যরা জেলার তিনজন শ্বেতাঙ্গ ম্যাজিস্ট্রেটকে হত্যা করেন। এই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত প্রদ্যোত ভট্টাচার্য, রামকৃষ্ণ রায়, ব্রজকিশোর চক্রবর্তী, অনাথবন্ধু পাঁজা প্রমুখ বিপ্লবীরাও ছাত্র বা তরুণ ছিলেন।

মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন (১৯৩০) বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ঘটনা। গণেশ ঘোষ, অনন্ত সিং, অম্বিকা চক্রবর্তী প্রমুখ বিপ্লবীরা, যাঁদের অনেকেই তরুণ বা ছাত্র ছিলেন, চট্টগ্রামে বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি’ নামে সংস্থা গঠন করে তাঁরা পুলিশ অস্ত্রাগার আক্রমণ ও লুণ্ঠন করেন এবং চট্টগ্রামে বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠা করেন। জালালাবাদ পাহাড়ের সংঘর্ষে বারো জন বিপ্লবী (যাঁদের অনেকেই তরুণ) নিহত হন। ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে সূর্য সেন ধরা পড়েন এবং ১৯৩৪-এ তাঁর ফাঁসি হয়।

ছাত্রদের এই সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং নির্ভীক আত্মত্যাগ সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনকে নিঃসন্দেহে প্রভাবিত করেছিল। তাদের কর্মকাণ্ড ব্রিটিশ প্রশাসনকে সন্ত্রস্ত করে তোলে, সাধারণ মানুষের মধ্যে সাহসের সঞ্চার করে এবং জাতীয়তাবাদী চেতনাকে আরও গভীর করে। তরুণ ছাত্রদের আত্মবলিদান বহু মানুষকে স্বাধীনতা সংগ্রামে অনুপ্রাণিত করেছিল এবং বিপ্লবী আন্দোলনকে দীর্ঘকাল ধরে বাঁচিয়ে রেখেছিল।

ঙ. ভারতবর্ষের দলিত সম্প্রদায়ের স্বার্থে আম্বেদকর যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন তার পরিচয় দাও। তোমার কী মনে হয় এই আন্দোলন দলিত সম্প্রদায়ের স্বার্থকে সুরক্ষিত করতে পেরেছিল?

উত্তর: গান্ধিজির হরিজন আন্দোলনের কর্মসূচি দলিতদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি। দলিতরা নিজেদের কংগ্রেসের ছত্রছায়ায় রাখতে চায়নি। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে নাগপুরে সর্বভারতীয় নিপীড়িত শ্রেণির নেতাদের সম্মেলনে ড. আম্বেদকর সমিতির সহ-সভাপতি নিযুক্ত হন, যদিও পরে ইস্তফা দেন। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে তিনি সর্বভারতীয় নিপীড়িত শ্রেণির কংগ্রেস গঠন করেন এবং উদ্বোধনী ভাষণে সরাসরি কংগ্রেস বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেন। তাঁর নেতৃত্বে দলিত আন্দোলন আরও ব্যাপক আকার ধারণ করে। এর পূর্বে ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে আম্বেদকর পুকুর থেকে জল তোলার অধিকার নিয়ে বিরাট সত্যাগ্রহ আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন এবং প্রকাশ্যে মনুস্মৃতি গ্রন্থ পুড়িয়ে দিয়ে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রে আঘাত হানেন। শৈশবে সামাজিক বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার হওয়ায় অল্প বয়সেই আম্বেদকর দলিতদের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষার বিষয়ে সচেতন হয়ে ওঠেন এবং দলিতদের জন্য একটি স্বতন্ত্র গোষ্ঠীর স্বীকৃতি আদায়ে সচেষ্ট হন।

১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে আম্বেদকর দলিতদের জন্য পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী দাবি করেন। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনে গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান করে দলিত শ্রেণির জন্য আইনসভায় আসন সংরক্ষণের দাবি জানান। এর ভিত্তিতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ম্যাকডোনাল্ড ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে ‘সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা’ ঘোষণা করলে গান্ধিজি তার বিরোধিতা করে জেলে অনশন শুরু করেন। এর ফলে বর্ণহিন্দু ও দলিত সম্প্রদায়ের নেতারা পুণেতে একটি চুক্তিতে (পুণাচুক্তি, ১৯৩২) আবদ্ধ হন, যা দলিতদের জন্য পৃথক নির্বাচনের বদলে সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা করে।

অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ নিয়ে গান্ধিজির সঙ্গে আম্বেদকরের মতানৈক্য স্পষ্ট ছিল। আম্বেদকর ১৯৩২-এ গান্ধিজিকে লেখেন যে, মন্দিরের দরজা খুলে দেওয়া বা উচ্চবর্ণের সঙ্গে বসে খাওয়ার মতো বিষয়ে তাঁর উৎসাহ নেই, কারণ এসব সত্ত্বেও দুর্দশা ভোগ করতে হয়; তিনি চান সামাজিক ও অর্থনৈতিক দুরবস্থার অবসান। আম্বেদকরের লক্ষ্য ছিল শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও রাজনৈতিক ক্ষমতা—সমস্ত ক্ষেত্রেই দলিতদের অধিকার সুনিশ্চিত করা। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি গান্ধিবাদী তথা বর্ণহিন্দুদের অবস্থানকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানান এবং হিন্দুধর্ম ত্যাগের কথা বলেন। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট লেবার পার্টি’ গঠন করেন, যা দলিত মানুষের লড়াইয়ের সঙ্গে শ্রমিক আন্দোলনকে যুক্ত করে। অবশেষে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে সর্বভারতীয় তপশিলি ফেডারেশন গঠিত হয়।

আন্দোলনের সাফল্য:

স্বাধীনতা লাভের পূর্বে কংগ্রেস দলিত আন্দোলনকে স্বীকৃতি দিতে চেয়েছিল। ড. আম্বেদকর সংবিধান খসড়া রচনা সভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তাঁর নেতৃত্বে রচিত সংবিধানে অস্পৃশ্যতাকে বে-আইনি ঘোষিত হয় এবং দলিতদের জন্য সরকার ১২ শতাংশ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে। এই দিক থেকে দেখলে, দলিত আন্দোলন সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অধিকার লাভে সফল হয়েছিল। আম্বেদকরের আন্দোলন দলিতদের মধ্যে আত্মমর্যাদা বোধ জাগ্রত করে, তাদের রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত করে এবং সাংবিধানিকভাবে তাদের অধিকার সুরক্ষিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই মনে করা যায় যে, এই আন্দোলন বহুলাংশে দলিত সম্প্রদায়ের স্বার্থকে সুরক্ষিত করতে পেরেছিল, যদিও সামাজিক বৈষম্য সম্পূর্ণভাবে দূর হতে আরও দীর্ঘ সময় লেগেছে।

অতিরিক্ত (Extras)

বহুনির্বাচনী প্রশ্ন (MCQs)

১. ‘ভারতীয় মহিলা সমিতি’ কে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন?

ক. কমলা নেহরু
খ. সরোজিনী নাইডু
গ. মুথুলক্ষ্মী রেড্ডি
ঘ. প্রভাবতী বসু

উত্তর: খ. সরোজিনী নাইডু

Missing answers are only available to registered users. Please register or login if already registered. How to register? Click on Menu and select Register

৪০. গান্ধিজির মতে, অস্পৃশ্যতা হল—

ক. সমাজবিরোধী কাজ
খ. অপরাধমূলক চর্চা
গ. মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ
ঘ. রাজনৈতিক অবিচার

উত্তর: গ. মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ

প্রশ্ন ও উত্তর (Questions, Answers)

১. ‘ভারতীয় মহিলা সমিতি’ কে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন?

উত্তর: সরোজিনী নাইডু মুথুলক্ষ্মী রেড্ডির সঙ্গে ভারতীয় মহিলা সমিতি (WIA) স্থাপন করেন।

Missing answers are only available to registered users. Please register or login if already registered. How to register? Click on Menu and select Register

২৭. শিক্ষার বিস্তার কিভাবে বিশ শতকের ভারতীয় নারী ও ছাত্র সমাজকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে অনুপ্রাণিত করেছিল?

উত্তর: বিশ শতকের ভারতে শিক্ষার বিস্তার নারী ও ছাত্র সমাজকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল।

নারী সমাজ: উনিশ শতকে নারীশিক্ষার প্রসারের ফলে এবং পণ্ডিতা রমাবাঈ, বেগম রোকেয়া, সাবিত্রীবাঈ ফুলে প্রমুখের প্রচেষ্টায় নারী সমাজ নিজেদের অবস্থান এবং দেশ-কাল-পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে। শিক্ষা তাদের জাতীয়তাবাদী ভাবধারার সঙ্গে পরিচিত করায়। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে দেশের মাতৃরূপ বন্দনা এবং ‘বন্দে মাতরম্’ ধ্বনি নারীদের জাতীয়তাবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ করে। চরমপন্থী আন্দোলনে কালী বা দুর্গার সংহাররূপিনী মূর্তিকে প্রেরণাস্বরূপ তুলে ধরা হলে জাতীয় আন্দোলনে নারীর অংশগ্রহণ আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। স্বদেশি আন্দোলনের সময় শিক্ষিত নারীরা বিদেশি বস্ত্র বর্জন, অরন্ধন পালন, বিপ্লবীদের আশ্রয়দান ও গোপনে সংবাদ সরবরাহ ইত্যাদি কাজে যুক্ত হন। সরলাদেবী চৌধুরানী ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখে এবং ব্যায়ামাগার স্থাপন করে নারীশক্তিকে উজ্জীবিত করেন। লীলা রায়ের ‘দীপালি সংঘ’ মেয়েদের বিপ্লবী আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত করতে লাঠিখেলা, শরীরচর্চা ও অস্ত্র চালানোর শিক্ষার ব্যবস্থা করে। শিক্ষা নারীদের শুধুমাত্র ঘরোয়া ভূমিকা থেকে বের করে এনে অসহযোগ, আইন অমান্য ও ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী এবং এমনকি সশস্ত্র বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে যোগদানেও সক্ষম করে তোলে।

ছাত্র সমাজ: শিক্ষা ছাত্র সমাজকে দেশের পরাধীনতা এবং ঔপনিবেশিক শাসনের শোষণ সম্পর্কে অবহিত করে। বিবেকানন্দের জাতীয়তাবাদী আদর্শ এবং বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দে মাতরম্’ মন্ত্র তাদের জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে। ছাত্ররা বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে ‘স্বনিয়োজিত প্রচারক’ হিসেবে কাজ করে, পিকেটিং ও বয়কটে অংশ নেয়। সরকারের দমননীতির (যেমন কার্লাইল সার্কুলার) প্রতিবাদে ছাত্রনেতা শচীন্দ্রপ্রসাদ বসুর নেতৃত্বে ‘অ্যান্টি-সার্কুলার সোসাইটি’ গঠিত হয়, যা বিকল্প জাতীয় শিক্ষার প্রসারে সাহায্য করে। বহু ছাত্র বিপ্লবী আদর্শে দীক্ষিত হয়ে গুপ্ত সমিতিতে যোগ দেয়, বোমা তৈরি ও সশস্ত্র সংগ্রামে অংশ নেয় (যেমন ক্ষুদিরাম বসু, প্রফুল্ল চাকী, যতীন দাস, ভগৎ সিং, বিনয়-বাদল-দীনেশ, বীণা দাস)। স্কুল-কলেজগুলি ক্রমশ রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রে পরিণত হয়। অসহযোগ আন্দোলনে ছাত্ররা সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বর্জন করে জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যোগ দেয়। ভারত ছাড়ো আন্দোলনে ছাত্রসমাজ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে ধর্মঘট, বয়কট, পিকেটিং থেকে শুরু করে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করা এবং সরকারি সম্পত্তি লুঠ করার মতো কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দেয়। আজাদ হিন্দ ফৌজের বন্দি সেনাপতিদের মুক্তির দাবিতে এবং রশিদ আলি দিবসে ছাত্ররাই বিক্ষোভের পুরোভাগে ছিল। ১৯৩৬ সালে নিখিল ভারত ছাত্র ফেডারেশন গঠিত হয়, যা ছাত্র আন্দোলনকে একটি সংগঠিত রূপ দেয়।

সুতরাং, শিক্ষার বিস্তার নারী ও ছাত্র উভয়ের মধ্যেই রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি করে, তাদের অধিকার সম্পর্কে সজাগ করে তোলে এবং ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী সংগ্রামে অংশগ্রহণের জন্য মানসিক ও বৌদ্ধিকভাবে প্রস্তুত করে তোলে। শিক্ষা তাদের সংগঠিত হতে এবং আন্দোলনের বিভিন্ন ধারায় (অহিংস ও সশস্ত্র) সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে অনুপ্রাণিত ও সক্ষম করেছিল।

Ron'e Dutta
Ron'e Dutta
Ron'e Dutta is a journalist, teacher, aspiring novelist, and blogger who manages Online Free Notes. An avid reader of Victorian literature, his favourite book is Wuthering Heights by Emily Brontë. He dreams of travelling the world. You can connect with him on social media. He does personal writing on ronism.

Get notes of other classes and subjects

NBSE SEBA/AHSEC
NCERT TBSE
WBBSE/WHCHSE ICSE/ISC
BSEM/COHSEM MBOSE
Share Feedback Question Papers
Notify change in syllabus/books Share PDFs of books, get benefits
Request notes not available now Share PDFs of question papers

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Only for Registered Users